সাদি মহম্মদ : কিংবদন্তি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী
১৩ মার্চ ২০২৪, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সাদি মহম্মদ প্রয়াত হয়েছেন। তার মৃত্যুটা অকস্মাৎ। আমাদের সবাইকে ভূমিকম্পের মতো ধাক্কা দিয়ে অতলে ফেলে দিলেন যেন। তাকে কি খুব চিনতাম বা জানতাম?
নাহ, খুব কাছে থেকে তাকে জানার সুযোগ মেলেনি, চিনতাম তো বটেই। আসলে জানার সুযোগ ছিল না। আমি সরাসরি তার ছাত্র ছিলাম না। ছায়ানটে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সরাসরি ছাত্র ছিলাম আমি। কিন্তু তারপরও সাদি ভাই সম্পর্কে জানাশোনা ছিল।
তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ফেসবুকে ‘সাদি মহম্মদ আর নেই’-এই খবর দেখার পর থেকেই ক্লান্ত লাগছে! সব অন্ধকার দেখাচ্ছে, বিমর্ষ লাগছে যেন!
আরও পড়ুন
আমাদের কৈশোরে সাদি ভাই আর বন্যা আপা শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। আহা, রবীন্দ্রনাথের গানে যেন নব জোয়ার আসে সেই সময়। টেলিভিশন খুললেই এই দুই গুণী শিল্পীকে দেখতে পেতাম। দ্বৈত বা একক কণ্ঠে।
২০০৫ সাল। উনি অনুষ্ঠান করতে বোস্টনে এলেন। দুপুরে এলেন আমাদের বাসায়। বন্ধু শায়লা জামান আর সুজন বিন ওয়াদুদ বোস্টন যাওয়ার পথে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন সাদি ভাইকে। ঘরে ঢুকেই উনি আমার প্রয়াত স্ত্রী নীতার হাতে তার নিজের একটা ভিডিও উপহার দেন।
একটা পুরো দিন আমরা গানে, আড্ডায় কাটিয়ে দিই। এইটুকু সময়ই তাকে কাছে পেয়েছিলাম। নীতা নানা কিছু বানিয়ে দুপুরের খাবার পরিবেশন করেছিলেসন। সাদি ভাই শিশুর মতো আনন্দ করে খেয়েছিলেন। রান্নার প্রশংসা করেছিলেন, একদম শিশুর মতোই প্রশংসা যেন।
১৩ মার্চ সারাদিন বিষণ্ন কেটেছে। নাহ, কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। অফিস থেকে ফিরে আমি আর মামনি মিলে সাদি ভাইয়ের একটা ইন্টারভিউ দেখলাম ইউটিউবে। তার কথা বলা যেন সেই সময়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমাদের।
আমাদের কৈশোরে সাদি ভাই আর বন্যা আপা শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। আহা, রবীন্দ্রনাথের গানে যেন নব জোয়ার আসে সেই সময়। টেলিভিশন খুললেই এই দুই গুণী শিল্পীকে দেখতে পেতাম। দ্বৈত বা একক কণ্ঠে।
১৯৭১ সাল। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি-১২/১০ বাড়ি। এই বাড়িতেই থাকতেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা সলিম উল্লাহ্, যিনি সাদি মহম্মদের বাবা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সূতিকাগার ছিল এই বাড়িটি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা মিটিং করতেন এখানে। এই বাড়িতে আসতেন বঙ্গবন্ধুপুত্র শহীদ শেখ কামালও।
আরও পড়ুন
২৩ মার্চ ১৯৭১। মঙ্গলবার। সলিম উল্লাহ্ তার সেজ ছেলে সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহর আঁকা বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান বাড়ির ছাদে।
সলিম উল্লাহ্র বাড়ির সামনেই মসজিদ। ২৬ মার্চ ১৯৭১। শুক্রবার। তিনি মসজিদ গেলেন। শুক্রবারের নামাজে গিয়েই তিনি বুঝেছিলেন, খুব খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। মসজিদে জড়ো হওয়া অবাঙালি বিহারিরা গুজব ছড়াতে থাকে। সলিম উল্লাহ্র বাড়ি থেকে মসজিদের দিকে গুলি ছোড়া হয়েছে। তিনি এইসব আঁচ করতে পেরেই বাড়িতে ফেরেন। নামাজ আর পড়া হলো না।
বিকেলের দিকে বাড়িতে ঢিল ছোড়া শুরু হয়। সন্ধ্যায় বাড়ির নিচতলায় আগুন দেওয়া হয়। রাত পর্যন্ত চলে এই হামলা। এরপর হত্যা করা হয় তার বাবা ও আত্মীয়স্বজনদের। সবই নিজের চোখে দেখেছেন কিশোর সাদি।
এই স্মৃতি তাকে গোটা জীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সেই স্মৃতি তীব্র দাগ টেনে দেয় সবার মনে। আহা, কী কষ্ট।
সাদি ভাই, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার পরিবারের অবদানের কথা জাতি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে। রাষ্ট্র আপনাকে কীভাবে স্মরণ করেছে, শ্রদ্ধা জানিয়েছে তা রাষ্ট্রের ব্যাপার। কিন্তু আমরা স্মরণ করবো আজীবন।
সাদি ভাই রাষ্ট্র থেকে কোনো পুরস্কার পাননি। কেন পাননি, জানি না। অথচ সাদি মহম্মদের তুলনায় কম যোগ্যতা সম্পন্ন লোক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন অতীতে! হায়! এটা পীড়া দেয় মনে। তবে কি রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় এমন কেউই নেই যে, সাদি মহম্মদ এবং তার পরিবারের কথা বলতে পারে বা বুঝতে পারে?
জানি না, সাদি ভাইয়ের মতো করে এই যুগে আর কতজন মা'কে এইভাবে ভালোবাসতেন। তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে জানলাম উনি মাতৃসেবার জন্য নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিলেন একটা সময়ে। এইরকম মা অন্তপ্রাণ মানুষ কি মেলে এই সময়?
সাদি ভাই রাষ্ট্র থেকে কোনো পুরস্কার পাননি। কেন পাননি, জানি না। অথচ সাদি মহম্মদের তুলনায় কম যোগ্যতা সম্পন্ন লোক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন অতীতে! হায়! এটা পীড়া দেয় মনে।
তার চলে যাওয়া আমাকে নাড়া দিয়ে গেছে প্রচণ্ডভাবে। আমাদেরও একদিন চলে যেতে হবে জানি। কিন্তু তাই বলে এভাবে চলে যাওয়া? সাদি ভাই কতটা বিষণ্ন ছিলেন যে রবি ঠাকুরের গান পর্যন্ত তাকে শেষ রক্ষা করতে পারল না!
তার চলে যাওয়া নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আরও ভেতরে গিয়ে ভাবতে হবে। যেন আর কোনো সাদি মহম্মদ এভাবে অকালে ঝরে না যায়।
প্রিয় সাদি ভাই, নিজেকে এই বলেই সান্ত্বনা দিচ্ছি, আপনি এখন মায়ের কোলে নিরাপদে ঘুমাতে পারবেন। আপনি ভালো থাকুন। শান্তিতে ঘুমান মায়ের কোলে।
আরও পড়ুন
আপনি ভালো থাকুন আনন্দলোকে। আপনি ভালো থাকুন অমৃতলোকে। আপনি ভালো থাকুন সুরালোকে।
বিদায় সুন্দর মানুষ, ভালো মানুষ। প্রণাম আপনাকে।
‘ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে,
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।
পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নূতন উঠবে ফুটে,
জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে।।’
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় এই অমোঘ বার্তা। শিল্পীর মৃত্যু নেই। সাদি ভাই, আপনিও থেকে যাবেন সকলের মনে, আপন গানে।
মহিতোষ তালুকদার তাপস ।। সংগীতশিল্পী