বিএনপির প্রতি কিছু কথা
প্রথমে বিএনপিকে ধন্যবাদ দিয়ে শুরু করতে চাই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তাদের কাছে প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা বিনয়ের সঙ্গে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি বলেছে, ছাত্রদের অর্জন। তারাই তাদের পছন্দমতো লোক দিয়ে সরকার গঠন করবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের এমন সম্মান দেওয়াটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
আরেকটা কারণে তাদেরকে ধন্যবাদ দেব। সেটি হচ্ছে, দেশব্যাপী সরকারি স্থাপনা, মন্দির-প্যাগোডা-গির্জা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর পাহারায় তারা কমিটি গঠন করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থী, নাগরিক, জামায়াত-শিবিরসহ ইসলামী পার্টিগুলোর পাশাপাশি তাদের নেতাকর্মীরাও সরকারি ও জনগণের সম্পদ রক্ষায় কাজ করবে। গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতিমধ্যে হয়ত তারা কাজ শুরুও করেছে।
পুলিশ বাহিনDর সদস্যরা পুরোপুরি কাজে না ফেরা পর্যন্ত জনগণকে সুরক্ষায় এমন মানবঢাল তৈরি করা অত্যাবশ্যক ছিল। সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের এমন ভূমিকায়ই দেখতে চায় সাধারণ মানুষ।
কিন্তু শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট, হামলা, দখলের ঘটনা ঘটেছে। নজিরবিহীন ওইসব ঘটনার কোনো কোনোটি কেউ কেউ হয়ত কাম্য বলতে পারেন। আবার এমনও বলতে পারেন যে, ১৬ বছরের দুঃশাসন আর দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তিকে জনতা সেলিব্রেট করেছে। কিন্তু সাধারণ জনতা আর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এক কথা নয়। উল্লিখিত অপ্রীতিকর ঘটনার সঙ্গে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও দরিদ্র ও উপার্জনবঞ্চিত কপর্দকশূন্য মানুষের লুটপাটে অংশ নেওয়ার ঘটনা বিচিত্র কিছু নয়। গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংসদ ভবনে যারা ঢুকেছে, তাদের সবাই বিএনপি নেতাকর্মী নয়। রাজনৈতিক কর্মীর তুলনায় বহুসংখ্যক সাধারণ ও উৎসুক জনতা প্রবেশ করেছে। তাই দেশব্যাপী লুটপাট ও ভাংচুরের শতভাগ দায়ভার তাদের দেওয়া যায় না। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেখানে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা দখলসহ আনুষঙ্গিক কিছু অন্যায়-অপকর্ম জনগণের চোখের সামনেই ঘটছে, সেসবের ব্যাপারে কী জবাব আছে?
দৃষ্টান্ত হিসেবে যদি পটুয়াখালীর বাউফলের কথা বলি। সেখানে পৌর বিএনপির সভাপতি দাবিদার জনৈক কবির ওরফে ”নাইয়া কবির” নামে একজন শহরের বিভিন্ন দোকানে তালা লাগানো আর চাঁদা পাওয়ার পর চাবি ফেরত দেওয়ার ব্যবসা শুরু করেছেন। এরমধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাড়ায় ডাকাতি হয়েছে। তাতেও ওই ব্যক্তির লোকেরা জড়িত বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা।
এখানেই শেষ নয়, এসব তথ্য যাতে গণমাধ্যমে না আসে সেজন্য সাংবাদিকদের চাপে রাখা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও কালের কণ্ঠের জেলা প্রতিনিধি এবং ৫ বার মিনা অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী সাংবাদিক এমরান হাসান সোহেলের বাসায় হামলা চালানো হয়েছে। তার ওপর চাপাতি হামলা চালানো হয়। আশপাশের ব্যক্তিরা চাপাতি ধরা হাত ঠেকাতে না পারলে হয়ত তিনি নিহত বা আহত হতেন। এছাড়া প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে ১৫ দিনের মধ্যে বাউফল ত্যাগের আলটিমেটামও দিয়েছেন ওই নেতার ক্যাডাররা। অথচ, সারাদেশে যেখানে সাড়ে ৪ শতাধিক থানা জ্বালিয়ে দেয়া হলেও স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী ও সাংবাদিকরা থানা এবং পুলিশকে জনতার হাত থেকে রক্ষা করে বাহবা কুড়িয়েছেন, সেখানে একজন মাত্র ব্যক্তির কারণে বিএনপি দুর্নাম কামাচ্ছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিভিন্ন ব্যাংকের সিবিএ, সচিবালয়সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে চলছে বিএনপি পন্থিদের জয়জয়কার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে এক কর্মকর্তা ও প্রফেসর জানালেন, “এতদিন বিএনপির এত নেতাকর্মী কোথায় ছিল ভেবে বিস্মিত হচ্ছি।” বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় তারেক রহমানকে সেবা দেওয়াদের একজন জানালেন, তাকে পর্যন্ত চার্জ করা হয়েছে যে, সে বিএনপি করে কিনা।
এগুলো কেবল কিছু দৃষ্টান্ত মাত্র। জানি না বিএনপি নেতৃত্ব এসবের খোঁজ রাখে কিনা। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি প্রশ্ন তোলে যে, ক্ষমতায় আসার আগেই কিছু নেতাকর্মী যদি এমন ভয়ানক রূপে আবির্ভূত হন, তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়?
আমরা লিখি বা না লিখি, ছাত্রজনতার কাছে বিগত কয়েকদিনের অপরাধ সব দৃশ্যমান। আওয়ামী লীগ এসব লিখতে দিতো না। বা তেলবাজরা লিখতেন না কিংবা ছাপতেন না অনেক সম্পাদক। তাই বলে, জনগণের দৃষ্টির বাইরে কী রাখা সম্ভব হয়েছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের অপকর্ম? সম্ভব যে হয়নি তার প্রমাণ এই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান।
আরেক প্রসঙ্গের অবতারণা করি। বিএনপি যে যুক্তিই দিক না কেন, ঢাকায় তাদের সমাবেশ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতে সমালোচনাকারীদের প্রোফাইলে গিয়ে আমি দেখেছি, তাদের মধ্যে আগের ফ্যাসিস্টদের দোসর ও সুবিধাভোগী আছেন। কিন্তু সাধারণ ছাত্রজনতাও পেয়েছি অনেক।
সুতরাং, এই মুহূর্তে তাদের এমন শোডাউনের প্রয়োজন ছিল কিনা- সেটা প্রশ্নের দাবি রাখে। বরং তারা বা শীর্ষ নেতারা যদি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ছাত্রজনতাকে দেখতে যেতেন, চিকিৎসায় সহায়তা করতেন, চিরতরে পঙ্গু হওয়াদের তালিকা করে স্থায়ীভাবে নিজেরা পুনর্বাসন করার ঘোষণা দিতেন বা সরকারের কাছে সুপারিশ করতেন, অথবা নিহতদের বাড়ি বাড়ি যেতেন, সান্ত্বনা দিতেন ও কবর জেয়ারত করতেন, সেটা অনেক বেশি প্রশংসিত যেমন হতো, তেমনি দলীয় শোডাউনও হতো।
আমি জানি না, বিএনপির মধ্যে থাকা ভারতপন্থি নেতারা (”র” এর এজেন্ট, যারা আন্দোলন বলতে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দেওয়ার পরামর্শ দেন, জনবান্ধব ইস্যুতে নয়) এমন কর্মসূচির পরামর্শ দিয়েছে কি-না। কিন্তু সমাবেশের মত এমন কর্মসূচিকে বিপ্লবী ছাত্রজনতা ভালো চোখে দেখছে না। সাধারণ মানুষও নয়।
আমি মনে করি বিএনপিকে দূরদর্শী হতে হবে। নিউ মিডিয়া আর বিকল্প মিডিয়ার যুগে যদি বিএনপি সনাতনী যুগের রাজনীতি নিয়ে হাজির হয়, তাহলে তাদেরকে মানুষ বর্জন করবে। তাদের মনে রাখা উচিত যে, জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে ফেসবুক-টুইটার গ্রুপ, যাদেরকে আহ্লাদ করে টিকটক গ্রুপ বলা হয়েছে। সাংবাদিককে কুপিয়ে আর এলাকা ছাড়া করে মূলধারার গণমাধ্যমে নিউজ বন্ধ করা গেলেও সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নতুন প্রজন্ম রাখে।
অন্যদিকে যারা এই জুলাই বিপ্লব করেছে, সেই শিশু-কিশোর-টিনএজারদের অনেক চাহিদা আছে। আওয়ামী লীগ সেসব পূরণ করতে পারেনি বলেই পরীক্ষা আর ক্লাসরুম ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তাই পুরানো বস্তা পচা কর্মসূচি দিয়ে নতুন বাংলাদেশের রাজনীতি চলবে না। গত কয়েকদিনেই প্রমাণিত হয়ে যে, যদি ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে না হয় তাহলে বাজারে সবজির দাম থাকে অর্ধেক। রিকশা-অটোভাড়াও কম থাকে।
এছাড়া এই আন্দোলন আরও অনেক কিছু শিখিয়ে ও দিয়ে গেছে। এখন যদি বিএনপি নেতৃবৃন্দ জনগণের বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মনের কথা পড়তে না পারেন তাহলে কিন্তু তাদের ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেই। এটা মনে করার সুযোগ নেই যে, তারা ক্ষমতায় এসে গেছে। তেমনটি ভাবলে তা গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল দেওয়ার মত অবস্থা হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া পার করেই তাদের ক্ষমতায় আসতে হবে। আর অনাগত সেই নির্বাচনে কিন্তু অন্যান্য দলও অংশ নেবে।
ইতোমধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অভিযুক্তদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা ও নির্দেশনা দিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে মানিকগঞ্জে কৃষক দল কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শুনেছি। আমরা ঘোষণা ও ব্যবস্থা উভয়ের প্রশংসা করি। কিন্তু আমরা দেখতে চাই, দেশে অন্যান্য স্থানে অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই। আর এটা ভাবার অবকাশ নেই যে, কেউ কোনো দলের জন্য অপরিহার্য। অথবা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে দলের অপরাধ স্বীকার করা হয়ে যায় ও দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই যুক্তির সঙ্গে আমরা একমত নই। বরং ব্যবস্থা নিলে দলের জনপ্রিয়তা বাড়বে। দলের প্রতি মানুষের ভালবাসা বাড়বে। মানুষকে এমন কথা বলতে বাধ্য করা উচিত নয় যে, আগেই তো ভাল ছিলাম।
তাই বিএনপি সৃজনশীল কর্মসূচি ও ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করে আবর্তিত হবে এমনটাই প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া তারা সরকার পতন শিখে গেছে।
সুতরাং, বিএনপি লুটপাট, ভাঙচুর ও অন্যান্য অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোরতা অবলম্বন করে বিদ্যমান অবস্থায় দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় বিএনপি কাজ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মুসতাক আহমদ ।। উইসকনসিন, যুক্তরাষ্ট্র