গাজায় যুদ্ধবিরতি : শান্তির পথে আশার আলো

গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা বহু প্রতীক্ষিত একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাত এবং এর ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় অবশেষে কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। গাজার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত আসলে কেবল একটি ভৌগোলিক সমস্যা নয় বরং এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি জটিল চিত্র।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধের ফলে লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। যুদ্ধ এবং সংঘাতের এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি এক নতুন আশা নিয়ে এসেছে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে। এটি শুধুমাত্র অস্ত্রের বিরতি নয় বরং এটি একটি রাজনৈতিক চুক্তি এবং এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে বিভিন্ন পক্ষের সহযোগিতার ওপর।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে এই যুদ্ধ শুধু গাজার জনগণের জন্য নয় বরং পুরো অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সম্প্রতি, গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে ইসরায়েল ও হামাস একমত হওয়ায় নতুন সম্ভাবনার সূচনা হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠছে গাজার যুদ্ধের কি একদম অবসান হচ্ছে?
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, জিম্মি ও বন্দিদের মুক্তির পাশাপাশি গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে; যা ইতিমধ্যে কার্যকর হচ্ছে। কাতার ও মিশর এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন আলোচনার সূচনা করেছে। গাজার যুদ্ধের আমলে বারবার যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু প্রত্যেকবার তা ভেঙে গেছে।
তবে, এবারে ইসরায়েল ও হামাস তাদের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে একমত হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, জিম্মি ও বন্দিদের মুক্তির পদক্ষেপ নেওয়া হবে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কাতার ও মিশর এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করছে, যা এই অঞ্চলের শান্তির জন্য আশা জাগাচ্ছে।
যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছে ১৯ জানুয়ারি থেকে, যা প্রাথমিকভাবে ৬ সপ্তাহ বা ৪২ দিন স্থায়ী হবে। এই সময়ের মধ্যে বন্দিদের মুক্তি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই তথ্যটি কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জাসিম আল থানি প্রকাশ করেছেন।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, জিম্মি ও বন্দিদের মুক্তির পাশাপাশি গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে; যা ইতিমধ্যে কার্যকর হচ্ছে।
এটি একটি উঁচু স্তরের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা যেখানে আল থানি জানান যে, গাজার যুদ্ধের অবসানে কাতার এবং মিশরের যৌথ প্রচেষ্টার ফলে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এই চুক্তি শুধু দুটি পক্ষের মধ্যেই নয় বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে কাজ করছে, যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বাইডেন প্রশাসন উভয়েই এ ব্যাপারে উৎসাহ প্রদর্শন করেছেন।
ট্রাম্পের মন্তব্য অনুযায়ী, ‘মধ্যপ্রাচ্যে জিম্মিদের জন্য আমাদের একটি চুক্তি হয়েছে। খুব শিগগির তাদের মুক্তি দেওয়া হবে।’ স্বাভাবিকভাবেই এটি শোনা যাচ্ছে যে, ট্রাম্পের প্রশাসনের আগ্রহ ও ফোকাস এই মেলবন্ধনের প্রেক্ষিতে নতুন গতি আনবে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একাধিক পোস্টের মাধ্যমে জনসমক্ষে এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
তার নির্দেশে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা দল ইসরায়েল এবং মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে, যাতে গাজা আর কখনো সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল না হয়। মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে, গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে তারা দলবদ্ধভাবে কাজ করছে। শিগগিরই তাদের পরিকল্পনার কথা প্রকাশিত হবে এবং প্রাথমিক ৬ সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি পরবর্তীতে স্থায়ী হতে পারে।
আরও পড়ুন
যুদ্ধবিরতি চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মানবিক সাহায্য। গাজা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ এবং সেখানকার জনগণ অত্যন্ত মানবিক সংকটে রয়েছে। বন্দিদের মুক্তি এবং যুদ্ধবিধ্বস্তদের সাহায্য করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধবিধ্বস্তদের জন্য সাহায্য পাঠানো হলে তা তাদের নতুন জীবন শুরু করার প্রত্যাশা বৃদ্ধি করবে। এক্ষেত্রে যুদ্ধবিধ্বস্তদের জন্য মানবিক সাহায্য পাঠানোর কথাও হয়েছে।
যুদ্ধের ফলে গাজার জনগণ যেসব সংকটের সম্মুখীন হয়েছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে দ্রুত প্রয়োজনীয় সাহায্যের দরকার। কাতারের প্রধানমন্ত্রী আল থানি বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, গাজায় চলমান যুদ্ধ শেষ করতে কাতার এবং মিশরের যৌথ প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।’ এই সহায়তা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা থাকলেও এতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই চুক্তি কতটা প্রভাবশালী হবে এবং তা কবে বাস্তবায়িত হবে? গাজার পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে সীমান্তের সংঘাত আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
এছাড়া হামাস এবং ফাতাহর মধ্যকার দ্বন্দ্বও এই শান্তির পক্ষে একটি বাধা। যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করার জন্য তাদের মধ্যে সমঝোতা করা প্রয়োজন, অন্যথায় এগুলোর ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করবে। যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট রয়ে গেছে।
প্রথমত, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য আন্তঃপ্রান্তীয় সমঝোতা থাকা অপরিহার্য। যদি কেবল বন্দিদের মুক্তি ও আইনি বিষয়াবলী সমাধান হয়, তাহলে পরিস্থিতি কি স্থায়ী হবে?
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধবিরতির পর যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে পুনর্গঠনের জন্য ব্যয়ের সংকট কতটা নিশ্চিত হবে সেটিও প্রশ্নের মুখোমুখি।
গাজার যুদ্ধবিরতির চুক্তি একটি নতুন সূচনা হতে পারে। এটি শুধুমাত্র একটি অস্ত্রবিরতি নয়, বরং এটি রাজনৈতিক সমঝোতারও একটি প্রক্রিয়া। যদিও চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে, তবে যদি সব পক্ষ একটি নতুন উচ্চতায় আসতে পারে, তাহলে গাজার জনগণের জন্য শান্তির নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।
গাজার মানুষ শান্তি চায় এবং তাদের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যদি এই চুক্তি সফল হয় তবে তা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন গতি আনতে পারে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির শেষ ফলাফল কীভাবে হবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে বর্তমান চুক্তির ফলে যে আশা জেগেছে তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক নির্মাণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। গাজার জনগণের জন্য স্থায়ী শান্তি এবং উন্নতির লক্ষ্যে আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির ফলে শান্তির আশা দেখা দিয়েছে, কিন্তু এর স্থায়িত্ব নিয়ে নির্ভর করবে রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি স্থায়ী সমাধান হলে গাজার জনগণের জন্য নতুন স্বপ্নের সূচনা হতে পারে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি একটি আশার আলো জ্বালিয়েছে, তবে এটি শুধুমাত্র একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। স্থায়ী শান্তির জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশল এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। দুই পক্ষের নেতৃবৃন্দদের উদারতা এবং দূরদৃষ্টির সঙ্গে কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে এই যুদ্ধবিরতি একটি টেকসই শান্তির পথের দিকে এগিয়ে যায়।
গাজার মানুষ শান্তি চায় এবং তাদের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যদি এই চুক্তি সফল হয় তবে তা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন গতি আনতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা এই যুদ্ধবিরতির টেকসই করতে পারে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য শক্তিগুলোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, এই প্রচেষ্টাগুলো অবশ্যই পক্ষপাতহীন এবং মানবিক হতে হবে।
অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়