বিজ্ঞানের আলোকে সরস্বতী পূজার মাহাত্ম্য

বাঙালি সংস্কৃতিতে দেবী সরস্বতীকে শিক্ষা, সংগীত, শিল্পকলার আশীর্বাদ ধাত্রী মনে করা হয়। বর্ষ পরিক্রমায় মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর পুণ্য তিথিতে সরস্বতী মায়ের পূজার দিন। শিক্ষা, সংগীত ও শিল্পকলায় জ্ঞানলাভের আশায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা ভক্তিভরে দেবী সরস্বতীর পূজা করে থাকে।
দেবী সরস্বতীর এক হাতে বীণা, অন্য হাতে থাকে পুস্তক। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী পার্বতী কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে শিব রুদ্রবীণা সৃষ্টি করেন। রুদ্র শিবের অপর নাম। রুদ্রবীণা বলতে ‘রুদ্রের বীণা’ বা ‘শিবের বীণা’ বোঝায়। বীণা একটি বাদ্যযন্ত্র হলেও এতে সুর রয়েছে বিধায় এটিরও জীবন আছে। বীণার সেই জীবন খুবই ছন্দময়। বীণার ঝংকারে ওঠে ধ্বনি বা নাদ।
বিদ্যার দেবী সরস্বতীর ভক্তরা একাগ্রচিত্তে কায়মনোবাক্যে সাধনার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করলে বীণার ধ্বনি শুনতে পায় বলে মনে করা হয়। বীণার সুর অত্যন্ত মধুর। বিদ্যার্থীদেরও মুখনিঃসৃত বাক্যও যেন বীণার মতো মধুর হয়। সেই কারণেই বিদ্যার দেবী সরস্বতীর হাতে বীণা। তাই সরস্বতীর আরেক নাম ‘বীণাপাণি’। তিনি কখনো বীণাপাণি (যাঁর হাতে বীণা শোভা পায়), কখনো বিদ্যাদাত্রী (যিনি বিদ্যা দান করেন), কখনো বীণাবাদিনী (যিনি বীণা বাজান), কখনো পুস্তকধারিণী (যিনি হস্তে পুস্তক ধারণ করেন), কখনো হংসবাহিনী (যে দেবীর বাহন রাজহংস) কখনো বাগদেবী (বাক্যের দেবী) নামেও পরিচিত।
এছাড়া তিনি শ্রুতদেবী নামেও কথিত হন। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। তাই সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী বা নদী। ধ্যানমন্ত্রে দেবী সরস্বতীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেত পদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে ভূষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণাপুস্তকধারিণী বলা হয়েছে।
সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। তিনি জ্ঞান, সংগীত, শিল্প এবং শিক্ষার সাথে যুক্ত। পার্বতী, সরস্বতী এবং লক্ষ্মী মিলে হলো ত্রিদেবী। একারণে সরস্বতী হলেন ত্রিদেবীর একজন। এই ত্রিদেবীর কাজ হলো ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে যথাক্রমে জগৎ, সৃষ্টি, পালন করতে সাহায্য করা। সরস্বতীর গায়ের রং শুভ্র (সাদা)। পদ্মাসনে অধিষ্ঠিত তিনি। এই পদ্মকে জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
পুরাণ অনুসারে বসন্ত পঞ্চমীতেই দেবী সরস্বতীর জন্ম হয়। সরস্বতীকে চার বেদের জননী বলা হয়। সূর্যের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছিলেন গায়ত্রী এবং বেদের সৌর দেবতা। গায়ত্রীকে বেদমাতাও বলা হয়। সরস্বতীর বাগ্মিতার ক্ষমতা ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে সরস্বতীকে 'বাগদেবী' নামে ভূষিত করেন ব্রহ্মা। বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারেন দেবী। এ কারণে সরস্বতীর আর এক নাম 'শতরূপা'।
দেবীকে শুক্লবর্ণা বলা হয়। শুক্ল বর্ণ মানে সাদা। আর সাদা হলো শুদ্ধ গুণের প্রতীক। সরস্বতী জ্ঞানে গুণান্বিতা বলে তার গায়ের রঙ শুক্লবর্ণ অর্থাৎ দোষহীনা। পবিত্রতার মূর্তি আর জ্ঞানদান করেন বলেই তিনি জ্ঞানদায়িনী। দেবী হংসবাহনা। জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস।
হিন্দু পুরাণে, হংস একটি পবিত্র পাখি। হাঁস অসারকে ফেলে সারকে গ্রহণ করে। দুধ ও জলের মিশ্রণ থেকে জল ফেলে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করে কিংবা কাদা মিশ্রিত স্থান থেকে শুধুমাত্র তার খাদ্য খুঁজে নিতে পারে। সরস্বতী পূজার সময় এই প্রার্থনা করা হয় যেন, অবিদ্যা থেকে বিদ্যাকে ছেঁকে নেওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায়। এটাই আসল শিক্ষা, তাই সরস্বতীর বাহন রাজহংস।
সরস্বতী পূজার পূর্বে কুল বড়ই (Ziziphus mauritiana) খাওয়া হয় না। এর ধর্মীয় ব্যাখ্যা হলো সরস্বতী দেবীকে তুষ্ট করার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব বদ্রিকাশ্রমে তপস্যা করেছিলেন। তপস্যা শুরুর আগে তাঁর তপস্যাস্থলের কাছে একটি কুল বীজ রেখে দেবী একটি শর্ত দেন। এই কুলবীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, গাছের ফুল থেকে নতুন কুল হবে।
দেবী বলেন, যেদিন সেই কুল পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হবে, সেইদিনই তাঁর তপস্যা পূর্ণ হবে বা সরস্বতী দেবী তুষ্ট হবেন। ব্যাসদেবও সেই শর্ত মেনে নিয়ে তপস্যা শুরু করলেন। ধীরে ধীরে বেশ কয়েক বছরে এই কুল বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, গাছের ফুল থেকে নতুন কুল হয় এবং একদিন তা পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হয়। তখন ব্যাসদেব বুঝতে পারেন যে, সরস্বতী দেবী তাঁর প্রতি তুষ্ট হয়েছেন। সেদিন ছিল পঞ্চমী। সেদিন বেদমাতা সরস্বতীকে বদ্রী/কুল ফল নিবেদন করে অর্চনা করে তিনি ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেন।
...বীণার সুর অত্যন্ত মধুর। বিদ্যার্থীদেরও মুখনিঃসৃত বাক্যও যেন বীণার মতো মধুর হয়। সেই কারণেই বিদ্যার দেবী সরস্বতীর হাতে বীণা।
শ্রীপঞ্চমীর দিন সরস্বতী দেবী তুষ্ট হয়েছিলেন। এ কারণে শ্রীপঞ্চমীর দিন সরস্বতী দেবীকে কুল নিবেদন করার পরেই কুল খাওয়া হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক কারণেও সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া ঠিক নয়। কারণ মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগে কুল কাচা বা কশযুক্ত থাকে। যেটি খেলে গলায় আটকে কাশি হতে পারে বা শ্বাসযন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হয়। সরস্বতী পূজার দিন সকালে উঠে স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে বাগদেবীর পূজা করা হয়। পূজার আগে শরীর ও মনের শুদ্ধির জন্য নিম পাতা (Azadirachta indica) ও কাঁচা হলুদ (Curcuma longa) বাটা দিয়ে শ্রীবৃদ্ধি করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। নিম পাতা ও কাঁচা হলুদ বাটা ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী। হলুদকে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক মনে করা হয়। শীতে উজ্জ্বল, কোমল ও দাগহীন ত্বক পেতে হলুদের তুলনা নেই।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে নিম পাতা শরীরের চুলকানি দূর করতে অত্যন্ত কার্যকর। দেবী সরস্বতীর মূর্তির সামনে জলভর্তি ঘট বসিয়ে তার ওপরে আম্রপত্র (Mangifera indica) রাখা হয়। তার ওপর পান পাতা (Piper betle) এবং একটি সুপারি (Areca catechu) রাখা হয়। পূজার স্থানে হলুদ, চাল (Oryza sativa), কুলসহ নানান প্রকারের মৌসুমি ফলমূল যেমন মটরশুঁটি (Pisum sativum), কলা (Musa spp.), বেল (Aegle marmelos), শাখ আলু (Pachyrhizus tuberosus), সিদ্ধ মিষ্টি আলু (Ipomoea batatas) ইত্যাদি রাখা হয়।
সরস্বতী পূজার অর্ঘ হিসেবে যেসব ফলমূল ব্যবহার করা হয় সেগুলো ঋতু ভিত্তিক এবং পুষ্টিমানে ভরা। পূজার সময় গাঁদা ফুল (Tagetes erecta এবং Tagetes patula) ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পলাশ (Butea monosperma) ফুলের ব্যবহার রয়েছে। শাস্ত্রমতে সরস্বতী পূজার মাধ্যমেই শীতের অবসান ঘটে।
অন্যদিকে পলাশ হলো বসন্তের প্রতীক। পলাশ ফুলে দিয়ে যেমন দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। তেমনি ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনেও পলাশ ব্যবহার করা হয়। কাকতলীয়ভাবে দুটি ক্ষেত্রেই বিদ্যার সাথে সম্পর্কিত।
পূজার সময় নৈবদ্য হিসেবে মুড়ি, চিড়া, মুড়কি, চিড়া-মুড়ির মোয়া, খাজা, খেজুরের রস, লুচি, সবজি আর দই দিয়ে পূজার প্রসাদ সাজানো হয়ে থাকে। খেজুরের রস হলো খেজুর গাছ (Phoenix dactylifera) থেকে সংগৃহীত রস। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে সরস্বতী পূজার উপবাসের পর খেজুরের রস পান করার রীতি ছিল।
খেজুরের রস হলো চিনিসহ নানা ধরনের ইলেট্রলাইটস সমৃদ্ধ পানীয়। উপবাসের কারণে শরীরের পানি শূন্যতা এবং শরীরের দুর্বলতা মেটাতে খেজুরের রসের কোনো জুরি নেই। যদিও বর্তমানে নিপাহ ভাইরাস আতঙ্কে ফ্রেশ খেজুরের রস পান বিপজ্জনক বলেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। তিনি জ্ঞান, সংগীত, শিল্প এবং শিক্ষার সাথে যুক্ত। পার্বতী, সরস্বতী এবং লক্ষ্মী মিলে হলো ত্রিদেবী। একারণে সরস্বতী হলেন ত্রিদেবীর একজন। এই ত্রিদেবীর কাজ হলো ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে যথাক্রমে জগৎ, সৃষ্টি, পালন করতে সাহায্য করা।
পুষ্পাঞ্জলির সময় নল খাগড়ার (Phragmites australis) কলম কপালে রেখে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে মন্ত্র পাঠ করা হয়। পুষ্পাঞ্জলি শেষে দেবীকে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায়।
পূজার পরদিন পুনরায় পূজার পর চিড়ে ও দই মিশ্রিত করে দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। যেকোনো পূজার বিসর্জনের আগেই দধিকর্মা করা হয়। কিন্তু বাগদেবীর আরাধনায় তা আবশ্যিক। শাস্ত্রমতে দধিকর্মা খাওয়ার উল্লেখ রয়েছে। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়।
পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায়। পূজার পরদিন পুনরায় পূজার পর চিড়া ও দই মিশ্রিত করে দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। উপবাস করে অঞ্জলি দেওয়ার পর খালি পেটে প্রসাদের ফল-মিষ্টি থেকে অ্যাসিডিটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সকালে দধিকর্মা খাওয়া পেটের জন্য ভালো।
দধিকর্মা সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণে অতুলনীয়। দুধ থেকে দই তৈরি করা হয়। দুধে বিদ্যমান ল্যাকটোজ শর্করার কারণে অনেকেই দুধ খেতে পারে না। তাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্ট বলা হয়। দুধ থেকে দই তৈরির সময় ল্যাকটোজ ভেঙে ল্যাকটিক এসিড হয়। যে জন্য দইয়ের স্বাদ টক হয় এবং ল্যাকটোজ ইনটলারেন্ট ব্যক্তিরা নির্ভয়ে দই খেতে পারেন। দই তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে আণুবীক্ষণিক ব্যাকটেরিয়া Streptococcus thermophilus এবং Lactobacillus bulgaricus।
দই নিজেই একটি পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য। সেই খাদ্য গ্রহণের সময় বাড়তি পাওনা হলো দইয়ের বিদ্যমান এই উপকারী ব্যাকটেরিয়া। এদের বলা হয় প্রোবায়োটিক (Probiotic)। প্রোবায়োটিক হলো নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়াল স্ট্রেন যা পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করা হলে অন্ত্রের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দিয়ে থাকে। নিয়মিত প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ দই খাওয়া যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো তেমনই সুস্থ দীর্ঘজীবন দিতে পারে।
তাই সরস্বতী পূজার সাথে দধিকর্ম একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পূজার নৈবেদ্য। এ থেকে প্রমাণিত হয় হিন্দু ধর্মের অনেক আচার বা রীতি বিজ্ঞান সম্মত। ধর্মান্ধতা দিয়ে নয়, বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক সব পূজাচার। পূজাকে ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের সাথে এদেশের জনগণের সংস্কৃতিতে পরিণত হোক এই প্রার্থনা করি।
অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা ।। চেয়ারম্যান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়