ফরিদ উদ্দিনের চারতলা বাড়ি এবং সাহারার ছাগল
দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেসরকারি টেলিভিশন সময় টেলিভিশন। প্রতিবেদনের কারণে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। আসামিরা হলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ জোবায়ের, জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক মানোয়ার হোসেন এবং প্রতিবেদক আফজাল হোসেন।
মামলার বাদী একজন সরকারি চাকরিজীবী- নোয়াখালী জজ কোর্টের নাজির আলমগীর হোসেন। গত ১৩ মে চট্টগ্রামের সাইবার আদালতে ৬ জনের বিরুদ্ধে এ মামলাটি দায়ের করেন তিনি।
প্রথম মামলাটি করেছেন নোয়াখালী দায়রা জজ আদালতে—দশ কোটি টাকার মানহানি মামলা। অপরটি চট্টগ্রাম দায়রা জজ আদালতের সাইবার ট্রাইব্যুনালে- অজামিন যোগ্য ধারায়। মামলাগুলোতে তিন সাংবাদিক ছাড়াও আসামি করা হয়েছে আরও তিনজনকে। বাকি তিনজন কারা?
খোঁজ নিয়ে জানা গেল তারা সবাই দুদকের কর্মকর্তা। যেদিন আমরা সবাই দেখলাম সচিবালয়ে এক সাংবাদিকের টুঁটি চেপে ধরেছেন সরকারি কর্মচারী ঠিক সেদিনই আমরা জানলাম নাজিরের মান ১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আফজাল হোসেনের প্রতিবেদনে তার দশ কোটি টাকার সম্মান ধুলোয় মিশে গেছে।
যেদিন আমরা সবাই দেখলাম সচিবালয়ে এক সাংবাদিকের টুঁটি চেপে ধরেছেন সরকারি কর্মচারী ঠিক সেদিনই আমরা জানলাম নাজিরের মান ১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আফজাল হোসেনের প্রতিবেদনে তার দশ কোটি টাকার সম্মান ধুলোয় মিশে গেছে।
এদিকে ৩৩৩-এ ফোন দিলে খাদ্য সহায়তা পাওয়া যায় রেডিওতে এমন তথ্য শুনে সেখানে ফোন দিলেন নারায়ণগঞ্জের ফরিদ উদ্দিন। পৌঁছেও গেল সরকারি লোক খাদ্য সহায়তা নিয়ে। ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের চক্ষু চড়ক গাছ! চার তলা বাড়ির মালিক চায় খাদ্য সহায়তা! ধরো ব্যাটাকে।
একশজনকে খাওয়াতে হবে তাকে। ইউএনও মহাশয় সদা তৎপর। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে সরকারি সহায়তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না কেউ। এটা হতেই পারে না। কিন্তু ঘটনার এই পর্যায়ে হাজির হয় সাংবাদিক নামের উটকো ঝামেলা। তারা মাটি খুঁড়ে তুলে আনেন অজানা খবর।
চারতলা বাড়ির একটি ক্ষুদ্র অংশের কেবল মালিক ফরিদ উদ্দিন। হোসিয়ারি কারখানা দীর্ঘদিন বন্ধ বলে কলেজ পড়ুয়া মেয়ের পড়াও বন্ধ। প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে বিপাকে তিনি। এবার নড়েচেড়ে বসেন ইউএনওসহ স্থানীয় প্রশাসন।
সুদ করে আনা টাকা দিয়ে কেনা খাবার মানুষের মাঝে বিতরণ করে ফেলেছেন ফরিদ। স্বয়ং ইউএনও উপস্থিত থেকে তদারক করেছেন সব। এবার ফরিদ উদ্দিনের টাকা ফেরত দেওয়ার পালা। কিন্তু সেই টাকা কোত্থেকে গেল- সরকারি তহবিল না ইউএনওর তহবিল থেকে? জিজ্ঞেস করে উত্তর মেলেনি।
এদিকে বগুড়ার আদমদীঘিতে ছাগলে গাছের পাতা খেয়েছে বলে ইউএনও মহাশয় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ছাগলকে জরিমানা করে বসলেন দুই হাজার টাকা! যদিও ইউএনও অস্বীকার করেছেন। তবে দুর্জনেরা বলেছেন, কর্তা মহাশয় নাকি পাঁচ হাজার টাকায় ছাগল বিক্রি করে জরিমানা বাবদ দুই হাজার রেখে বাকি তিন হাজার মালিককে ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য ছাগল ফেরত দেওয়া হয়েছে সাত দিন পর।
সর্বগ্রাসী লাগামহীন দুর্নীতি দমনের রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক ইচ্ছার কাছে তা পরাজিত হবেই বারবার। কারণ আমলারা খুব ভালো করেই জানেন, সিদ্ধান্ত নেবেন তারা...
জরিমানার টাকাও নাকি ইউএনও মহাশয় পরিশোধ করেছেন। ছাগলকে জরিমানা করা হয়েছিল পাবলিক ন্যুইসেন্স আইনে (The Penal Code, 1860; Punishment for public nuisance)। ঘটনা দেখে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন পাবলিক ন্যুইসেন্স আসলে কে বা কারা?
শুরু করেছিলাম দুর্নীতির রিপোর্ট করার মামলা দিয়ে। ফিরে আসি সেখানেই। এতক্ষণ বলা হলো মাঠ পর্যায়ের সরকারি কর্তাদের কাজের ফিরিস্তি নিয়ে। নাজির যে দু’দুটি মামলা করেছেন ছয়জনের বিরুদ্ধে। এর পেছনেও নাকি আছেন এক বড় কর্তা।
দুদক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেই বড় কর্তার আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বাড় বেড়েছে নাজিরের। তো বড় ভবনে বসে বড় কর্তারা যদি এমন সব আশ্রয়-প্রশ্রয় জাতীয় কাজ করেন তাহলে মাঠ পর্যায়ের কর্তারা ছাগল নিয়ে ব্যস্ত থাকলে, আর করোনাকালের মধ্যবিত্তের চাপা কান্না ধরতে না পারলে তার দায় কার?
সর্বগ্রাসী লাগামহীন দুর্নীতি দমনের রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক ইচ্ছার কাছে তা পরাজিত হবেই বারবার। কারণ আমলারা খুব ভালো করেই জানেন, সিদ্ধান্ত নেবেন তারা, রাজনৈতিক অংশকে যেকোনো ভাবেই হোক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তা করে ফেলবেন। এর জন্য যদি কোনো জবাবদিহি দিতে হয় জনগণের কাছে তা দেবেন রাজনৈতিক নেতারা।
আমলাদের তো সেটা করতে হয় না। সাহারা বেগম বা ফরিদ উদ্দিনের দুয়ারে ভোটের জন্য যাবেন রাজনৈতিক নেতা। আমলা তখন আদমদীঘি কিংবা নারায়ণগঞ্জে থাকবেন না।
পুনশ্চ: ব্যতিক্রম তো আছেই। অনেকেই ভালো কাজ করেন, করছেন। সবাই তো আর দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতা নন।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী