কানে বাংলাদেশের স্বাক্ষর

বাংলাদেশের জন্য ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে বড় খবরটা হলো—এই প্রথমবারের মতো মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের লড়াই করে স্পেশাল মেনশন সম্মাননা অর্জন করল। আদনান আল-রাজীব পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের ‘আলি’ ছবিটি নিয়ে শুরু থেকেই একধরনের প্রত্যাশা ছিল, বিশেষ করে ছবিটি যখন কানের প্রতিযোগিতা বিভাগে স্থান পেল।
এরপর রাজীব ও ‘আলি’ টিমের সাথে, কান যাত্রার মাত্র কয়েকদিন আগে ৭ মে ২০২৫, একটি ছোট ঘরোয়া পার্টিতে আলাপ হয়। ফরাসি রাষ্ট্রদূত মারি মাসদ্যুপুইয়ের বাসায় হওয়া সেই পার্টিতে রাজীব তো বটেই, প্রত্যেকের চোখেমুখেই দেখা যাচ্ছিল উজ্জ্বল আভা। সেদিন রাষ্ট্রদূত মারি শুভ কামনা করে বলেছিলেন নিশ্চয় ‘আলি’ কোনো সুখবর বয়ে আনবে। তার কথা ফলে গেছে।
তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ কানের প্যারালাল সেকশন ডিরেক্টর্স ফোর্টনাইট থেকে ফিপ্রেসি পুরস্কার যখন পেল, সেই ২০০২ সালে, বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের কাছে কান উৎসবে যাওয়ার স্বপ্নটা তখন থেকেই বোধহয় মূর্ত হতে শুরু করে। এরপর দীর্ঘ বিরতি।
২০২১ সালে কানের অফিশিয়াল সেকশন ‘আঁ সাখতা খোগাদে’ স্থান পেল আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। এরপর আর বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি, চার বছরের মাথাতেই, ২০২৫ সালে শুধু অফিশিয়াল সেকশনে জায়গা নয়, পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনাও ঘটে গেল। অর্থাৎ কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের রেখাচিত্রটি ঊর্ধ্বমুখী।
‘আলি’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের শাখায় স্থান পেয়েছে। এখন আমাদের চাঁদমারি কানের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মূল কম্পিটিশন বিভাগ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ফরাসিদের ঘর থেকে স্বর্ণপত্র বয়ে নিয়ে আসবে বাংলাদেশের মাটিতে।
তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ কানের প্যারালাল সেকশন ডিরেক্টর্স ফোর্টনাইট থেকে ফিপ্রেসি পুরস্কার যখন পেল, সেই ২০০২ সালে, বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের কাছে কান উৎসবে যাওয়ার স্বপ্নটা তখন থেকেই বোধহয় মূর্ত হতে শুরু করে।
২০২৫ সালের উৎসবে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে থাকা চলচ্চিত্রগুলো কিন্তু বেশ বৈচিত্র্যময় ছিল। পাম-ডি’অর পাওয়ার দৌড়ে জোর আলোচনায় ছিল চারটি চলচ্চিত্রের নাম—ইরানি পরিচালক জাফর পানাহির ‘ইট ওয়াজ জাস্ট এন এক্সিডেন্ট’, ডেনিশ বংশোদ্ভূত নরওয়েজিয় পরিচালক জোয়াকিম ট্রিয়ের নির্মিত ‘সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু’, ইউক্রেনের সের্গেই লজনিৎসা পরিচালিত ‘টু প্রসেকিউটর্স’, এবং মার্কিন নির্মাতা রিচার্ড লিংকলাতার পরিচালিত ‘ন্যুভেল ভাগ’।
এরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট শক্তিশালী পরিচালক। জাফর পানাহি ১৯৯৫ সালে প্রথম ছবি ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ বানিয়ে শুরুতেই কান চলচ্চিত্র উৎসবে পেয়ে যান ক্যামেরা ডি’অর পুরস্কার। ইরানি নিউ ওয়েভ জমানার দ্রোহী পরিচালক পানাহি এরপর একের পর এক নির্মাণ করেছেন ‘দ্য মিরর’, ‘অফসাইড’, ‘ক্লোজড কার্টেইন’, ‘থ্রি ফেসেস’ ও ‘নো বেয়ার্সে’র মতো চলচ্চিত্র, যা তাকে বিশ্ব চলচ্চিত্রে অনন্য স্থান করে দেয়। তার সাথে এবার প্রতিযোগিতায় ছিলেন জোয়াকিম ট্রিয়ের।
নরওয়ের এই পরিচালক ২০২১ সালে ‘দ্য ওর্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ বানিয়ে কান উৎসবের জুরিদের মুগ্ধ করেছিলেন, প্রশংসা পেয়েছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচকদের। সেবার কানে পাম-ডি’অর না পেলেও, তার ছবিটি অর্জন করেছিল সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। ইউক্রেনের পরিচালক লজনিৎসারও কিন্তু পূর্বে কানে আসার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০১৮ সালের কান উৎসবে ‘আঁ সাখতা খোগাদ’ বিভাগের উদ্বোধনী ছবি ছিল এই লজনিৎসার ব্ল্যাক কমেডি ওয়ার ফিল্ম ‘ডনবাস’।
আরও পড়ুন
মার্কিন পরিচালক রিচার্ড লিংকলাতার ৭৮তম কানে এনেছেন জঁ-লুক গদারকে ট্রিবিউট দিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ন্যুভেল ভাগ’। কানে এর আগে তার কোনো প্রাপ্তি নেই। কিন্তু ১৯৯৫ সালে ‘বিফোর সানরাইজ’ করে তিনি বার্লিনে হয়েছিলেন সেরা পরিচালক, অর্জন করেছিলেন সিলভার বিয়ার। অস্কারে তিনি পাঁচবার মনোনয়ন পেয়েছেন। ‘বয়হুড’ ছবির জন্য ২০১৪ সালে অর্জন করেছেন গোল্ডেন গ্লোব এওয়ার্ড।
২০১৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনের একশ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকাতেও ছিল রিচার্ডের নাম। কাজেই অনুমান করা যাচ্ছে, এবারের প্রতিযোগিতা ছিল সমানে সমান। তবে ইরান সরকারের দমন ও পীড়নমূলক আচরণ পানাহিকে, হয় তো, কিছুটা এগিয়ে রেখেছিল এই স্বর্ণপত্র অর্জনের দৌড়ে। তাকে অভিনন্দন। এত জেল-জুলুম ও বিধিনিষেধের ভেতরেও তিনি যেভাবে চলচ্চিত্র বানিয়ে যাচ্ছেন তা নজিরবিহীন।
কান চলচ্চিত্র উৎসব বলুন, অথবা একাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার), কোনো কিছুই তো আর রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়। রাজনীতিকে আমলে নিলেও, যাদের পুরস্কার দেওয়া হয় এসব মঞ্চ থেকে তারা নিঃসন্দেহে মাস্টার ফিল্মমেকার। তাদের ছবি নানা স্তরে গিয়ে দর্শকের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম।
তাছাড়া গোটা পৃথিবীতে কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেওয়া মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের ছবিগুলো নিয়ে সবারই সমীহ কাজ করে। অর্থাৎ, এই বিভাগে এলেবেলে ছবি স্থান পায় না। যতই তারা টম ক্রুজকে মাতামাতি করুক না কেন, হলিউডের সেসব মাম্বোজাম্বো ছবিকে তারা রাখে মূল প্রতিযোগিতার বাইরে, অনেকটা শো-পিসের মতো।
কান চলচ্চিত্র উৎসব বলুন, অথবা একাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার), কোনো কিছুই তো আর রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়। রাজনীতিকে আমলে নিলেও, যাদের পুরস্কার দেওয়া হয় এসব মঞ্চ থেকে তারা নিঃসন্দেহে মাস্টার ফিল্মমেকার।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, এদেশের মানুষের কাছে এসব শো-পিসের খবরই বেশি দৃশ্যমান হয় এবং লাল গালিচায় হাঁটা তারকাদের ছবিই তাদের চোখে বেশি পড়ে। সেজন্য অনেকেরই ধারণা কান চলচ্চিত্র উৎসব হলো কেবল চাকচিক্য ও দেখনদারির উৎসব। যেখানে খোদ চলচ্চিত্র বিষয়টির সাথেই গ্ল্যামার জড়িত, সেখানে চলচ্চিত্রের এক নম্বর উৎসবে চাকচিক্য থাকবে না?
তবে আমি হলফ করে বলতে পারি, এই লালগালিচা বলি বা পোশাকের ঝলক, এগুলো সমগ্র কানের পনের শতাংশ হবে। বাকি সব অংশে, দর্শক দেখার সুযোগ পান, শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র কোন উচ্চতায় উঠতে পারে, শিল্পের কোন পরাকাষ্ঠা ছুঁতে পারে সিনেমা। কারণ কানের বাছাই প্রক্রিয়াই এমন। তারা এমনভাবে চলচ্চিত্রকে প্রোগ্রামিং করেন, যাতে বর্তমান বিশ্বে যারা চলচ্চিত্রের ভাষাকে সময়ের সাথে জারণের মাধ্যমে ভিন্ন মাত্রা যোগ করছেন, তাদের কাজ স্থান করে নেয় মূল প্রতিযোগিতা বিভাগগুলোয়।
কান ও বার্লিন, দুটো চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৫তম আসরে আমার ক্রিটিক জুরি হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। কানে ২০২২ সালে এবং বার্লিনে ২০২৫ সালে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অধুনায় যেসব পরিচালক, নিজেদের স্থানিকতাকে অর্থাৎ নিজ ভূখণ্ডের সমাজ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির কথা একটি সর্বজনীন চলচ্চৈত্রিক ভাষায় বলতে পারছেন, একটি বৈশ্বিক রূপ দিতে পারছেন, তাদের ছবিই কিন্তু প্রশংসিত হচ্ছে এবং পুরস্কৃত হচ্ছে।
আমার ধারণা বাংলাদেশের পরিচালকরা সেই সূত্রটি ধরতে পেরেছেন। ধরতে পারার সুফলটাই কিন্তু আমরা পাচ্ছি। কান, টিফ, মস্কো, বুসান ইত্যাদি চলচ্চিত্র উৎসবে দেখতে পাচ্ছি আমাদের পরিচালকরা সুখবর বয়ে আনছেন একের পর এক। এটা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য সুদিন বয়ে আনবে।
বিধান রিবেরু ।। কাট টু সিনেমা’র সম্পাদক ও চলচ্চিত্র গবেষক
