ক্রীড়া বাজেট : প্রতিভা অন্বেষণে দরকার সুনির্দিষ্ট প্রকল্প

বরাবরের মতো ক্রীড়া বাজেট, আগের সরকারের পথেই হেঁটেছে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারও! কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো তারুণ্যের সরকারও যুব ও ক্রীড়াখাতের বাজেটে নতুন কোনো চমক দেখাতে পারেনি! ক্রীড়াখাতে বাজেটের বিশাল অংশ পরিচালন ব্যয়, উন্নয়ন খাতে যে বরাদ্দ আছে তার বড় অংশ আবার খরচ হবে অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারে! বরাবরের মতো প্রতিভা অন্বেষণ, লালন ও উন্নয়নের বরাদ্দ আহামরি কিছু নয়!
অর্থ উপদেষ্টা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের যে বাজেট দিয়েছেন তাতে গত অর্থবছরের পাশ হওয়া বাজেটের তুলনায় টাকার পরিমাণ বেশি আছে ৮৪২ কোটি টাকার ওপরে। এটা চোখে পড়ার মতো। তবে এর বড় অংশ চলে যাবে যুব খাতে। দেশের যুব সমাজের প্রভাব রয়েছে এই সরকারের ওপর, সুতরাং তাদের উন্নয়নে বড় একটা অংশ যাবে সেটা ধরে নেওয়া যায়!
দুই খাত মিলিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন। পাশ হওয়ার পর অঙ্ক কিছুটা কমতে পারে। ক্রীড়াখাতে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প উপজেলা পর্যায়ে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের দ্বিতীয় পর্যায়!
গত সরকারের আমলে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে দুর্নীতির খবর নতুন নয়, এবার আবারও সেই প্রকল্পে বড় বরাদ্দ থাকছে। যেখানে ক্রীড়াঙ্গনকে সরব রাখতে খালি মাঠের প্রয়োজন, তরুণদের মাঠে নিয়ে আসতে টুর্নামেন্ট ও খেলার সামগ্রীর দরকার, সেদিকে না তাকিয়ে স্টেডিয়াম বানাতেই নজর বেশি মন্ত্রণালয়ের!
স্টেডিয়াম বানানো ও সংস্কারে দিনের পর দিন বরাদ্দ বাড়ছে, কিন্তু তাতে কি কাজ হচ্ছে? প্রতিভাবান খেলোয়াড় কি বেরিয়ে আসছে? আন্তর্জাতিক সাফল্যের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে এখানে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি!
প্রায়শই শোনা যায় এদেশে স্থায়ী অলিম্পিক ভিলেজ করবে সরকার, যেখানে প্রস্তুত হবেন অ্যাথলেটরা! শুধু অবকাঠামোকেন্দ্রিক চিন্তা কেন? কেন নয় বিকেএসপিকেন্দ্রিক চিন্তা? বিকেএসপিতে ২১টি ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা ও খেলাধুলা শেখানো হয়...
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সরকারের শুধু ক্রীড়া উন্নয়নেই রয়েছে বিশেষ প্রোগ্রাম ‘খেলো ইন্ডিয়া’! এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস ও অলিম্পিক গেমসকে সামনে রেখে নেওয়া হয় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ২০৩৬ সালে দেশটি অলিম্পিক আয়োজন করতে চায়। ধাপে-ধাপে ক্রীড়া উন্নয়নে ভারত সরকার প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ বাড়াচ্ছে।
পেশাদারি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে। কোনো খেলায় ছোট নয়, অলিম্পিক পদক আসতে পারে এমন সব ইভেন্ট ও অ্যাথলেটদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াচ্ছে ভারত সরকার। এজন্য এখন থেকে ১০টি শহরে উন্নত অলিম্পিক প্রশিক্ষণ সেন্টার তৈরি করছে তারা।
এশিয়ার মাল্টি স্পোর্টসে সেরা দু’টি দেশ চীন ও জাপানকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। মূল লক্ষ্য গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের পদক তালিকায় নিজেদের অবস্থার উত্তরণ এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে এই প্রকল্পে তারা প্রাইভেট সেক্টরকেও যুক্ত করছে।
সবার আগে তারা ১০টি ডিসিপ্লিনকে নির্ধারণ করছে, আর প্রত্যেকটি ডিসিপ্লিনের জন্য একেক শহরকে নির্ধারণ করা হবে। ধরেন আর্চারির জন্য তারা ঠিক করলো জয়পুরকে, স্প্রিন্টের জন্য কলকাতা। এভাবে দশটি শহরে দশটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দশটি ডিসিপ্লিনের প্রত্যেকটিতে থাকবে দেড়শ জন করে বাছাই করা তরুণ প্রতিভা।
আরও পড়ুন
এসব তরুণদেরও তারা বাছাই করছে ‘খেলো ইন্ডিয়া’ প্রোগ্রামের আওতায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। এজন্য তারা প্রত্যেকটি ডিসিপ্লিনের অধীনে তৈরি করেছে দক্ষ স্কাউট ও প্রশিক্ষক! সর্বশেষ প্যারিস অলিম্পিকে ভারত মাত্র ছ’টি পদক জিতেছিল। এখন সেই সংখ্যা বাড়ানোর জন্য তৎপর ভারতের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
দেখুন, শুধু তথাকথিত বাজেট করে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নতি সম্ভব না! বাধ্য হয়ে চীন-জাপানের পথ ধরেছে ভারত, সেখানে বাংলাদেশ কী করছে? বিশ্ব ক্রীড়ায় মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে যেরকম পরিকল্পনা করা দরকার তার ধারে কাছে নেই এদেশ, বাস্তবায়ন তো সুদূরপরাহত।
প্রায়শই শোনা যায় এদেশে স্থায়ী অলিম্পিক ভিলেজ করবে সরকার, যেখানে প্রস্তুত হবেন অ্যাথলেটরা! শুধু অবকাঠামোকেন্দ্রিক চিন্তা কেন? কেন নয় বিকেএসপিকেন্দ্রিক চিন্তা? বিকেএসপিতে ২১টি ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা ও খেলাধুলা শেখানো হয়, কিন্তু সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বহু অভিযোগ রয়েছে বছরের পর বছর!
সেখান থেকে সাকিব আল-হাসান- মুশফিকুর রহিমের মতো ক্রিকেটার, আসিফ হোসেন খানের মতো শ্যুটার, মামুনুল ইসলামের মতো ফুটবলার পেয়েছে দেশ, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেটা কি নস্যি নয়?
বিকেএসপি প্রতিষ্ঠার পেছনের যে কারণ সেটির ফল কি বাংলাদেশ ভোগ করতে পেরেছে সত্যি সত্যি? মোটেও নয়। সাভারের সদরদপ্তরের পাশাপাশি দেশের বেশ কয়েকটি বিভাগীয় শহরে রয়েছে এই বিকেএসপির আঞ্চলিক শাখা। এই শাখাগুলো নিবিড় পরিচর্যার জন্য নির্ধারণ করে ভারতের মতো দীর্ঘমেয়াদি কৌশল তো বাংলাদেশও নিতে পারে?
এজন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে এই প্রকল্পে বছরওয়ারী বাজেট প্রণয়ন দরকার, দরকার হবে একটি মনিটরিং সেল! ক্রীড়াঙ্গনে বিপুল কর্মযজ্ঞের উপস্থিতি বাতাসটাই বদলে দিতে পারে এখানে। কিন্তু সেরকম কোনো প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কখনো দেখে যেতে পারবো কিনা জানি না!
১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ! পৃথিবীতে এত জনসংখ্যার আর কোনো বিশাল জাতি নেই যাদের কিনা অলিম্পিকে কোনো পদক নেই! এটা বড়ই লজ্জার, বড়ই আফসোসের বিষয়! প্রতিবার অলিম্পিক আসে, যে দু-চার জন সেখানে যায়, তারা প্রাথমিক লড়াইয়েই বাদ পড়ে যায়। পদক তো বহু দূরের বিষয়!
পৃথিবীতে এত জনসংখ্যার আর কোনো বিশাল জাতি নেই যাদের কিনা অলিম্পিকে কোনো পদক নেই! এটা বড়ই লজ্জার, বড়ই আফসোসের বিষয়! প্রতিবার অলিম্পিক আসে, যে দু-চার জন সেখানে যায়, তারা প্রাথমিক লড়াইয়েই বাদ পড়ে যায়। পদক তো বহু দূরের বিষয়!
আসর শেষে কিছু কথা শোনা যায় ভবিষ্যৎ নিয়ে, তারপর সবাই আবার চুপচাপ হয়ে যায়! অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস নিয়ে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা থাকে না; বাজেটে কোনো বিশেষ বরাদ্দ হতেও দেখি না!
সবার আগে সরকারের আন্তরিকতা থাকতে হবে খেলাধুলার উন্নয়নে, শুধু অবকাঠামো নির্মাণ আর রক্ষণাবেক্ষণ করে ক্রীড়াঙ্গনের উন্নতি হয় না! একটা সংস্কৃতি গড়তে হয়, স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও যার জন্য আফসোস করতে হয়। এমনিতে দক্ষিণ এশিয়া খেলাধুলায় পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল অঞ্চল, বাংলাদেশ এখানে আরও দুর্বল। এই অঞ্চলে ভারত-পাকিস্তান তো অবশ্যই, এমনকি শ্রীলঙ্কার আন্তর্জাতিক সাফল্যও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি!
ধরেন ২০৩৬ সালের অলিম্পিকের আয়োজক হলো ভারত। বরাবরের মতো সেবারও ৫/৭ জন অ্যাথলেট গেল বাংলাদেশ থেকে এবং হিটেই বাদ পড়লো, অন্যদিকে ভারতীয়রা একের পর এক জিততে থাকলো পদক—একজন বাংলাদেশি হিসেবে কেমন লাগবে আপনার?
পাশের বাড়িতে উৎসব চলছে, সেখানে আয়োজক ও অতিথিরা খুবই উজ্জ্বল, আর আপনি মুখ কালো করে হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন—এ দৃশ্য কি দেখতে চান? তাই বলবো, সময় আছে, ক্রীড়া উন্নয়নে মনোযোগ দিন।
আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রতিভা লালন না করতে পারলে সময় শেষে কোনো লাভ নেই! তাই চীন-জাপান-ভারতকে অনুসরণ করুন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করুন, বাজেট বরাদ্দে নির্দিষ্ট খাত ঘোষণা করুন। দয়া করে গুরুত্ব দিন প্রতিভা অন্বেষণে।
মানজুর মোরশেদ ।। এডিটর, টি-স্পোর্টস
