সংকটকালে সাংবাদিকতা কেমন হওয়া উচিত

আগুন লাগে, ভবন ধসে পড়ে, কেউ চিৎকার করে ওঠে। আর ক্যামেরাগুলো একে একে ছুটে আসে দুর্ঘটনাস্থলের দিকে। কেউ চিৎকারের রেকর্ড নেয়, কেউ লাইভে যায়, কেউ আবার নিহতের মুখ ক্লোজআপে ধরার প্রতিযোগিতায় নামে। ওদিকে উৎসুক জনতার ভিড়ে উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। জনতার ভিড় থেকেও চালু হয় শত শত মোবাইল। বাংলাদেশের মতো দুর্ঘটনাপ্রবণ অঞ্চলের ক্ষেত্রে এই চিত্র প্রতিনিয়ত প্রকট হচ্ছে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়।
আবার একটা বিপরীত চিত্রও আছে। সাংবাদিক কিংবা পেশাদার কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের দোষ খুঁজতে অনেকেই তথ্যপ্রমাণ ছাড়া সমালোচনা শুরু করেন। ‘ভিউ শিকারি’ বলে আখ্যা দিতে থাকেন। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোধসম্পন্ন সাংবাদিক এবং কনটেন্ট ক্রিয়েটররা কাজের সময় নিরাপদ দূরত্বে থেকেই দৃশ্য ধারণ করেন।
দু-একজন থাকেন, যারা সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা ভুলে কিংবা অজ্ঞতার কারণে এমন আচরণ করেন যা দুর্ঘটনা কবলিত ভিকটিম বা ভুক্তভোগীর জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই লেখা তাই দোষ খোঁজার নয়, পথ খোঁজার। এখানে আমি সেই ভার অনুভব করব, তুলে ধরব মাঠের অভিজ্ঞতা। সেই মুহূর্তের যন্ত্রণা, দ্বিধা, দায়িত্ব ও প্রতিবন্ধকতা। খুঁজে দেখব আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নীতিমালা।
তথ্য মন্ত্রণালয় বা নীতিনির্ধারকদের জন্য যদি কোনো নোট তৈরি হয়, আমি চাই এই লেখাটি তার প্রারম্ভিকা হোক। আগুন নিভে গেলে, ধসের ধুলো বসে গেলে, ক্যামেরা বন্ধ হলেও সাংবাদিকতার বিবেক যেন জ্বলতে থাকে। যাতে আমরা একসঙ্গে ভাবতে পারি—সংকটকালে কেমন হওয়া উচিত সাংবাদিকতা।
সংকটময় সময়ে যখন কেউ স্পষ্টভাবে কষ্টে থাকেন, তখন প্রথমে মানবিক সহানুভূতি নিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করা জরুরি, কারণ প্রথমে আপনি মানুষ, পরে সাংবাদিক। পাশাপাশি এটাও স্মরণে রাখুন যে সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে সাহায্য করা নয়, সত্য ঘটনা জানানোই মূল কাজ।
গণমাধ্যমভিত্তিক সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ডিজিটাল যুগের বাস্তবতা মাথায় রেখে ট্রেনিং আউটলাইন তৈরি করা। প্রিন্টের যুগে যে ধরনের প্রশিক্ষণ হতো, তা ফেলে না দিলেও আপডেট করতেই হবে।
Columbia University’র Dart Center-এর ‘TRAUMA & JOURNALISM A Guide For Journalists, Editors & Managers’ গাইডলাইনে বলা হয়েছে, ‘‘Where individuals are in obvious distress, accept that you may sometimes need to offer help and support before you can report. You’re a human being first, after all, and a journalist second. At the same time, remember that you’re not there professionally to rescue, and that you can help by getting the story.
“Approach people with care, respect and kindness. Take a moment to introduce yourself, make eye contact and explain why you would like to talk to them. Take it slowly and don’t rush-however chaotic the circumstances. Don’t just stuff a microphone in someone’s face and expect an interview.”
অর্থাৎ, সংকটময় সময়ে যখন কেউ স্পষ্টভাবে কষ্টে থাকেন, তখন প্রথমে মানবিক সহানুভূতি নিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করা জরুরি, কারণ প্রথমে আপনি মানুষ, পরে সাংবাদিক। পাশাপাশি এটাও স্মরণে রাখুন যে সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে সাহায্য করা নয়, সত্য ঘটনা জানানোই মূল কাজ। এ সময় মানুষের সঙ্গে সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে, নিজের পরিচয় দিতে হবে, ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে কথা বলতে হবে-অর্থাৎ পরিস্থিতি যতই অস্থিতিশীল হোক, জোর করে বা দ্রুত কোনো সাক্ষাৎকার নেওয়া উচিত নয়।
আরও পড়ুন
সাংবাদিকদের ট্রমা-সংবেদনশীল হতে হবে, আবেগগত দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং এমন প্রশ্ন বা চিত্রায়ন এড়িয়ে চলতে হবে যা অতিরিক্ত যন্ত্রণার কারণ হতে পারে।
এ ধরনের প্রশিক্ষণ সাংবাদিকদের শুধু তথ্য সংগ্রহ নয় বরং মানবিক বোধ ও সাংবাদিকতার নৈতিক মান বজায় রাখতে সহায়তা করে।
লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডের (Grenfell Tower Fire, 14 June 2017) ঘটনা থেকে আমরা একটি দিকনির্দেশনা পেতে পারি। ৭২ জনের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সম্প্রচার নিয়ন্ত্রক সংস্থা Ofcom তাদের ‘Section eight: Privacy’তে স্মরণ করিয়ে দেয়:
Broadcasters should not take or broadcast footage or audio of people caught up in emergencies, victims of accidents or those suffering a personal tragedy, even in a public place, where that results in an infringement of privacy, unless it is warranted or the people concerned have given consent.
(Ofcom Broadcasting Code, Section 8: Privacy, 8.16:)
অর্থাৎ, দুর্ঘটনা, জরুরি পরিস্থিতি বা ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিতে আক্রান্ত ব্যক্তির ছবি বা বক্তব্য ধারণ ও সম্প্রচার করা থেকে গণমাধ্যমের বিরত থাকতে হবে, এমনকি ঘটনাটি প্রকাশ্যে বা কোনো জনবহুল স্থানে ঘটলেও; যদি তা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে, তবে গণমাধ্যমকর্মীর অবশ্যই সংযত থাকা জরুরি। অবশ্য এই ধরনের সম্প্রচার তখনই গ্রহণযোগ্য, যদি বৃহৎ স্বার্থে তা যুক্তিসংগত হয় বা ভুক্তভোগীদের সম্মতি থাকে।
BBC Editorial Guidelines, Section Section 12 এর 12.2.2 এ বলা হয়েছে, “It is important that human dignity is respected without unduly sanitising the realities of war, terror, disasters and similar events. There must be strong editorial justification for the use of very graphic content.”
এই নীতিগুলোর সারমর্ম হলো, “জনস্বার্থ ও মানবিকতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে; বাড়াবাড়ি পরিহার করতে হবে; কষ্ট পাচ্ছে বা কষ্টকর ছবি অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রকাশ করা যাবে না।”
গ্রেনফেল ট্র্যাজেডির পর BBC, Guardian এবং Channel 4—স্থানীয় জনগণের শোক ও সম্মান রক্ষা করে দায়িত্বশীল রিপোর্টিংয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। রিপোর্টাররা ক্ষতিগ্রস্তদের পরিচয় প্রকাশ না করে পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেও ব্যক্তিগত শোককে আড়াল রাখেন, যা প্রশংসিত হয়।
বাস্তব রিপোর্টিং চ্যালেঞ্জ:
ঢাকার চকবাজার, বনানী, নিউমার্কেট, সীতাকুণ্ড, দিয়াবাড়ি—এসব দুর্ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জন্য শারীরিকভাবে কাজ করাই কঠিন হয়ে পড়ে। জনতার ভিড়, অপরিকল্পিত অবকাঠামো এবং কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিড়ে পরিবেশ আরও জটিল হয়।
রিপোর্টারদের মধ্যে অনেকেই জুনিয়র, আর গেটকিপার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়ররাও প্রায়শ সঠিক ব্রিফিং দেন না। ফলে অনভিজ্ঞ হাতে সেনসিটিভ রিপোর্ট তৈরি হয়।
একজন অখ্যাত কনটেন্ট ক্রিয়েটরের চেয়ে কোনো জনপ্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর ভুল তথ্য বা ভিডিওর প্রভাব অনেক বেশি। Communication theory-তে ‘two-step flow of influence’ মডেলে আমরা দেখি, সাধারণ মানুষ মূলত opinion leader অর্থাৎ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমেই তথ্য গ্রহণ করে। পাশাপাশি, algorithms জনপ্রিয় ব্যবহারকারীর কনটেন্টকে বেশি ভিজিবিলিটি ও রিচ দেয়, যা ভুল তথ্যের ব্যাপক বিস্তারে ভূমিকা রাখে। মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে গুজবের উৎস ছিল এমনই একজন, যিনি মিলিয়ন ফলোয়ার-সম্পন্ন এবং ‘জনপ্রিয় মুখ’।
নাগরিক সাংবাদিকতা: আশীর্বাদ না অভিশাপ?
এটা নির্ভর করে আমরা কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি তার ওপর। সচেতন নাগরিকেরা অনেক সময় তথ্য দেন বা ছবি তুলে দেন। কোথাও নিজের অধিকার ক্ষুণ্ন হলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এতে দ্রুত সমস্যার প্রতিকার মেলে। জুলাইয়ের আগে কিংবা দিনগুলোতে কনটেন্ট ক্রিয়েটরা নাগরিক সাংবাদিকতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
ওই সময় প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম যা দেখাতে পারেনি, যা বলতে পারেনি সেসব প্রকাশ করেছেন ছোট ছোট কনটেন্ট ক্রিয়েটর। আমি অসংখ্য কনটেন্ট ক্রিয়েটর কাছ থেকে দেখেছি, যারা জুলাইয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলমান ঘটনা তুলে ধরেছেন। আবার কেউ কেউ দৃষ্টিকটু ও বেসামাল আচরণ করেছেন ডলার বা ভিউ-এর লোভে। এখানেই গেটকিপারশিপের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, যা তাদের নেই।
Shoemaker & Vos, Gatekeeping Theory-তে উল্লেখ আছে, আজকের যুগে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব একক কোনো সংস্থার নয় প্রত্যেক ব্যবহারকারীই একেকজন গেটকিপার। সেজন্যই দরকার সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ। Dart Center কিংবা BBC Academy’র মতো সংস্থাগুলো যেভাবে "trauma-informed coverage" প্রশিক্ষণ দেয়, আমাদের এখানে সেই মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।
মিডিয়া হাউজ ও নীতিমালা:
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমের নিজস্ব আচরণবিধি নেই। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশের অনেক মিডিয়া হাউজে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। দেখেছি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান মুখে-মুখে সিদ্ধান্ত নেয় ‘কী যাবে, কী যাবে না’।
...ধোঁয়ার ভেতর শুধু দেহ নয়, সাংবাদিকতার নৈতিকতাও যেন হারিয়ে না যায়—সেটা আমাদের খেয়াল রাখা যেমন জরুরি, তেমনি ধসে পড়া ভবনের মতো দায়িত্বশীলতার কাঠামোটিও যেন ভেঙে না পড়ে তাও স্মরণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
ভয়েস অফ আমেরিকায় কাজ করার সময় ‘NEWS STANDARDS & BEST PRACTICES’ দেওয়া হয় আমাদের। নিয়মিত বিরতিতে এই গাইডলাইনের ওপর প্রশিক্ষণ চলতো। সবটাই লিখিত। কিছুই মুখে মুখে না। এর পাশাপাশি ফিল্ড রিপোর্টারদের জন্য ‘রিয়েল টাইম গাইডলাইন’ আছে, যা বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমে অনুপস্থিত।
প্রশাসন-মিডিয়া সমন্বয়:
উদ্ধারকাজ ও তথ্যপ্রবাহ-দুটোই জরুরি। এ জন্য ‘Emergency Coverage Coordination Cell’ গঠন করা যেতে পারে, যাতে গুজব ঠেকানো যায় এবং সংঘর্ষ এড়ানো যায়।
ধোঁয়ার ভেতর শুধু দেহ নয়, সাংবাদিকতার নৈতিকতাও যেন হারিয়ে না যায়—সেটা আমাদের খেয়াল রাখা যেমন জরুরি, তেমনি ধসে পড়া ভবনের মতো দায়িত্বশীলতার কাঠামোটিও যেন ভেঙে না পড়ে তাও স্মরণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র:
১. TRAUMA & JOURNALISM A Guide For Journalists, Editors & Managers: https://dartcenter.org/sites/default/files/DCE_JournoTraumaHandbook.pdf
২. Ofcom Section eight: Privacy:
https://www.ofcom.org.uk/tv-radio-and-on-demand/broadcast-standards/section-eight-privacy
৩. BBC Editorial Guidelines:
https://www.bbc.com/editorialguidelines/guidelines/war-terror-and-extreme-violence-disaster-and-disorder/guidelines
৪. Shoemaker & Vos, Gatekeeping Theory: https://www.taylorfrancis.com/chapters/mono/10.4324/9780203931653-10/individual-level-analysis-pamela-shoemaker-timothy-vos?context=ubx&refId=efe986be-3e53-4d61-a293-74dba4030b82
অমৃত মলঙ্গী : ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট, ভয়েস অফ আমেরিকা; এআই ও ডিজিটাল মিডিয়া ট্রেইনার, নেটকম লার্নিং
amritamalangi.com