কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি রাজনৈতিক কৌশল নিয়ন্ত্রণ করবে?

রাজনীতি মানব সমাজের পুরোনো ক্ষেত্রগুলোর একটি। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ক্ষমতার বণ্টন, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং নাগরিক অংশগ্রহণ—সবই রাজনীতির মূল আলোচ্য বিষয়। রাজনীতির উৎপত্তি হয়ে থাকে সংঘাত এবং অপর্যাপ্ততা থেকে। আর এই সংঘাত এবং অপর্যাপ্ততার ধারণাটি রাজনীতিকে নানাভাবে নানা দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পর থেকে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি আজ রাজনীতিকে এক নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence-AI) এখন শুধু বিজ্ঞান বা অর্থনীতির সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে নয় বরং রাজনীতির কাঠামো, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং এমনকি রাজনৈতিক দর্শনের ভেতরেও প্রবলভাবে প্রবেশ করছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, নাকি কেবল প্রভাব বিস্তার করছে? আর এই প্রভাবকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? সেই আলোচনা এবং দর্শন নিয়েই আজকের এই লেখা।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, রাজনীতির মূল শক্তি হলো তথ্য ও মতাদর্শ। অতীতে রাজনৈতিক প্রচারণা সীমিত ছিল সমাবেশ, পোস্টার, লিফলেট বা সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যম রাজনৈতিক বার্তা প্রচারের প্রধান হাতিয়ার।
এ জায়গায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষা থেকে শুরু করে নাগরিকদের কল্যাণে নানামুখী প্রয়োগ ঘটাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আসামি শনাক্ত করার ক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাচ্ছে।
ফেসবুক, টুইটার, টিকটক কিংবা ইউটিউবের অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে দেয় কোন বার্তা কোন শ্রোতার কাছে পৌঁছাবে। এই অ্যালগরিদমগুলো আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি গাণিতিক মডেল। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই অ্যালগরিদম বুঝতে পারে, তারা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী লক্ষ্য করে বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে। এভাবে ভোটারদের মনোভাব নিয়ন্ত্রণের এক নতুন খেলা শুরু হয়েছে।
আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কিংবা ব্রেক্সিট গণভোটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডেটা বিশ্লেষণ (যেমন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি) কীভাবে নির্বাচনী ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের অনলাইন আচরণ বিশ্লেষণ করে তাদের রাজনৈতিক পছন্দ অনুমান করতে সক্ষম এবং সেই অনুযায়ী ‘মাইক্রো-টার্গেটিং’ করা সম্ভব হয়। শুধু ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, ক্রমাগতভাবে এ ধরনের প্রভাব আজকের দিন পর্যন্ত অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে—এমনকি বেড়েই চলেছে।
ফেসবুক, টুইটার, টিকটক কিংবা ইউটিউবের অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে দেয় কোন বার্তা কোন শ্রোতার কাছে পৌঁছাবে। এই অ্যালগরিদমগুলো আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি গাণিতিক মডেল। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই অ্যালগরিদম বুঝতে পারে, তারা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী লক্ষ্য করে বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে।
রাজনৈতিক দর্শন মূলত ন্যায়, সমতা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ধারণা ঘিরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই দর্শনকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। প্রশ্ন উঠছে, যখন কোনো সিদ্ধান্ত অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে, তখন গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ কী? একজন নাগরিক যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুপারিশকৃত খবর পড়ে ভোট দেয়, তবে কি সেটি তার ব্যক্তিগত মতামত, নাকি একটি যান্ত্রিকভাবে প্রভাবিত সিদ্ধান্ত?
আবার, সরকার যদি নীতিনির্ধারণে AI ব্যবহার করে, যেমন অপরাধ প্রবণতা পূর্বাভাস বা বাজেট বণ্টনে কোন খাত কতটুকু প্রয়োজন তা নির্ধারণ—তাহলে মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কতটা কার্যকর থাকে?
রাজনৈতিক দার্শনিকরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গণতন্ত্রে নতুন ধরনের ‘টেকনোক্রেসি’ তৈরি করছে, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ধীরে ধীরে মানুষের হাত থেকে অ্যালগরিদমের হাতে চলে যাচ্ছে। জন রলসের ‘ন্যায়বিচারের তত্ত্ব’ কিংবা হাবারমাসের ‘যোগাযোগমুখী গণতন্ত্র’—এগুলো এখন নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে হচ্ছে, কারণ রাজনৈতিক যোগাযোগই যখন যন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা কতটা অবশিষ্ট থাকে সেটিই বড় প্রশ্ন।
এখানেই মার্ক কোকেলবার্গ তার বই “The Political Philosophy of AI” (2022)-এ গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু প্রযুক্তি নয়, এটি একটি রাজনৈতিক শক্তি, যা ক্ষমতার কাঠামোকে পুনর্গঠন করছে। তিনি দেখিয়েছেন, AI-এর অ্যালগরিদমিক ক্ষমতা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে এমনভাবে প্রভাবিত করছে যে, তা প্রথাগত গণতান্ত্রিক আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কোকেলবার্গের ভাষায়, এটি এক ধরনের “অদৃশ্য রাজনৈতিক অভিনেতা”, যার উপস্থিতি আমরা সরাসরি টের না পেলেও এর প্রভাব আমাদের সিদ্ধান্ত ও অংশগ্রহণে প্রতিদিন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রাজনৈতিক অংশগ্রহণকেও বদলে দিয়েছে। আগে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে সরাসরি অংশ নেওয়া ছিল অংশগ্রহণের অন্যতম মাধ্যম। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট শেয়ার করা, হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা কিংবা অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করাই অনেক সময় রাজনৈতিক অংশগ্রহণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
AI-চালিত প্ল্যাটফর্মগুলো এই অংশগ্রহণকে আরও ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ করে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন তরুণ ইউটিউবে যখন বারবার পরিবেশ রক্ষার ভিডিও দেখে, অ্যালগরিদম তাকে একই ধরনের কনটেন্ট সাজেস্ট করতে থাকে। ফলে সে ধীরে ধীরে পরিবেশবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে শুরু করে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় তার রাজনৈতিক সচেতনতা বৈচিত্র্যময় না হয়ে একমুখী হয়ে পড়ে, যাকে আমরা বলি filter bubble বা echo chamber।
অন্যদিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে আরও গণতান্ত্রিকও করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক উন্নত দেশে AI-চালিত চ্যাটবট ব্যবহার করে নাগরিকদের মতামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে নীতিনির্ধারকরা জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চাহিদা সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছেন। তবে এর নিরপেক্ষতা কতটা বজায় থাকে, সেটিও বিতর্কের বিষয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাজনীতিতে প্রভাব একপাক্ষিক নয়। এর ভেতরে যেমন সুযোগ আছে, তেমনি ঝুঁকিও রয়েছে। সুযোগ হিসেবে আমরা বেশকিছু বিষয়কে নির্ধারণ করতে পারি। যথা-
১) নীতিনির্ধারণে দ্রুত তথ্য বিশ্লেষণ ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা;
২) দুর্নীতি, অপরাধ বা সামাজিক বৈষম্যের প্রবণতা আগেভাগে চিহ্নিত করার সুযোগ; এবং
৩) নাগরিক অংশগ্রহণের নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি।
অন্যদিকে ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনায় নিতে পারি-
১) রাজনৈতিক প্রচারণায় ভুয়া খবর (deepfake, misinformation) ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি;
২) নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে মতামত প্রভাবিত করার সম্ভাবনা;
৩) গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মানুষের ভূমিকা হ্রাস পাওয়া।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো অনেকাংশে দলকেন্দ্রিক। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বড় পরিবর্তন আনছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফেসবুক-ভিত্তিক প্রচারণা, অনলাইন ট্রেন্ড এবং ভাইরাল ভিডিও রাজনৈতিক বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
রাজনৈতিক দর্শন মূলত ন্যায়, সমতা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ধারণা ঘিরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই দর্শনকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।
যদি আমরা দায়িত্বশীলভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে পারি, তবে এটি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও গতিশীল করতে পারে। যেমন, ভোটার তালিকা হালনাগাদে AI ব্যবহার, দুর্নীতি শনাক্তকরণে ডেটা বিশ্লেষণ বা নাগরিক অভিযোগের সমাধানে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। তবে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এড়িয়ে নিরপেক্ষভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রাজনীতিকে শুধু প্রভাবিত করছে না, বরং ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের অবস্থানে চলে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দর্শন, গণতন্ত্রের ধারণা এবং অংশগ্রহণের ধারা—সবকিছুই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। একদিকে এটি রাজনীতিকে কার্যকর, স্বচ্ছ ও তথ্যভিত্তিক করতে পারে।
অন্যদিকে এটি গণতন্ত্রকে যান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রিত করে তোলার ঝুঁকিও তৈরি করছে। অতএব, এখনই প্রয়োজন সচেতনতা, আইনগত কাঠামো এবং নৈতিক নীতিমালা তৈরি করা। অন্যথায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক করার বদলে এক নতুন ধরনের ‘ডিজিটাল স্বৈরতন্ত্রে’ পরিণত করতে পারে।
মার্ক কোকেলবার্গের বিশ্লেষণ থেকে শিক্ষা নিয়ে বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কেবল প্রযুক্তি হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রীয় আলোচনার অংশ হিসেবে দেখা জরুরি। নচেৎ আমরা অজান্তেই এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে চলে যেতে পারি, যেখানে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা অ্যালগরিদমিক কাঠামোর ভেতর বন্দী হয়ে পড়বে।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
