একই চক্রে ঘুরছে দেশের রাজনীতি ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন

১৯৪৭ সালের দেশভাগ আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রণ্ট নির্বাচন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১-এর মহান মক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন কিংবা ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলন— স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বের ও পরের রাজনৈতিক ইতিহাসের মিল যেন ঈদের কোলাকুলির মতো।
পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক দল কিংবা সামরিক শাসক বা অরাজনৈতিক গোষ্ঠী ক্ষমতার মসনদে বসেছেন, তাদের মধ্যেই কেউ কেউ স্বল্প সময়ের জন্য কিংবা দীর্ঘ সময়ের জন্য স্বৈরতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের প্রভাব খুব বেশি দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি সরকারের সময়েই। স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকবার জন্যই কখনো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার আবার কখনো সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে। ক্ষমতা সবসময় এখানে জনগণের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে। জনগণের সম্মিলিত আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল জনগণ কখনো ঘরে তুলতে পারেনি; মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী লুটেছে যত ফায়দা।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ফসল হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পছন্দের- নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যা ক্ষমতার পালাবদলের জন্য একটি নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা। কিন্তু এতেও শেষ পর্যন্ত শান্তি আসেনি। জনগণ দেখেছে আরেকটি মহাপরাক্রমশালী স্বৈরাচারী সরকার।
৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার দলিল বাংলাদেশের মহান সংবিধান। আমরা দেখেছি ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলো বারবার নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য মহান এই সংবিধানে বারবার সংশোধনী এনেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পছন্দের নির্বাচনকালীন সরকারেরও অতি লোভ-লালসার শিকার হয়েছে এদেশের জনগণ। আমরা দেখতে পেয়েছি কী করে ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টি করে নব্বই দিনের সরকার দুই বছর পার করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন
এদেশের জনগণ দেখতে পেয়েছে স্বাধীনতার চরম বিরোধিতাকারী পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধুমাত্র ক্ষমতায় অধিষ্টিত হওয়ার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল কীভাবে এক মঞ্চে তুলে এনে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে। আমরা সময়ের স্বাক্ষী হিসেবে দেখতে পেয়েছি ৮২ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা চিহ্নিত স্বৈরাচারকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে একাধিকবার।
তেমনিভাবে দেখতে পেয়েছি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে পিছপা হয়নি। তাও ক্ষমতার মসনদে যাবার জন্য। এদেশ দেখতে পেয়েছে ১৯৯৬ সালে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কী করে অসাংবিধানিক উপায়ে রাজপথে নিয়ে আসা হয় রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য। যাতে চরমভাবে ভেঙে পড়ে দেশের প্রশাসনিক কাঠামো।
আমরা দেখেছি ২০২৪-এর জুলাইয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলন সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় এবং আন্দোলনের ফলস্বরূপ একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়। এক আন্দোলনেই সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার মৃত্যুর মিছিলও আমরা দেখেছি। দেখেছি প্রায় বিশ হাজার নিরস্ত্র মানুষকে আহত হতে।
আমরা দেখছি বছরের পর বছর রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি বিভাগ আবিষ্ট হয়ে আছে দুর্নীতিতে। সেই দুর্নীতির মহাজাল থেকে বের করে আনার প্রাণান্ত চেষ্টা এখন চলছে বলা হচ্ছে। নানা সংস্কারের নামে কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবচিত্র হলো, আমরা যেই তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি। আর্থ-সামজিক অবস্থা বিবেচনায় কোনো পরিবর্তন উপলব্ধি করতে পারছি না। জুলাই আন্দোলনের পর শুধু জুলাই স্পিরিটকে পুঁজি করে অনেক রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটেছে। অনেকে অনেক রকম সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু জনগণ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না।
আরও পড়ুন
বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, প্রত্যেকটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের সময় নেতিবাচক মন্তব্য। সুস্থ রাজনীতির পরিবর্তে অসুস্থ রাজনীতির চর্চা করা যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি আমাদের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালেই দেখি ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এসোসিয়েশনেও দেখতে পাই লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন সমাজের প্রতিটি স্তরে সাজানো রয়েছে লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক চর্চা। ব্যবসায়ী আর সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোও পিছিয়ে নেই। সবাই কেমন যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মোহাবিষ্ট। লেজুড়বৃত্তির চর্চা করলে এমপি-মন্ত্রী হওয়া যায়। এ লোভ যেন সমাজে আষ্টেপৃষ্টে আছে, আছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
আসলে আমাদের নীতির নয় নৈতিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারের সমালোচনা, সরকারি কর্মকর্তাদের সমালোচনা, নীতি নির্ধারকদের কাজের সমালোচনা সহ্য করতে পারে না কেউ। সমালোচনা একটি সুস্থ সমাজ গঠনে অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। আসুন সমালোচনাকে গ্রহণ করে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করি। নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য কাজ করি।
মা-মাটি-মানুষ আমরা সবাই এদেশের প্রাণ। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। নিজের জন্য নয় দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারলেই আমরা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও উন্নত দেশ পাব।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট
