দীপাবলির দীপের আলো, দূর করে দিক আঁধার-কালো

আলো ও অন্ধকার—এই দুই বিপরীত চিহ্ন মানব মনের গভীরে একটি চিরকালীন দ্বন্দ্ব রচনা করে। ‘আলো’ হলো বোধ ও জ্ঞান। অপরদিকে ‘অন্ধকার’ হলো অজ্ঞানতা ও বিভ্রম।
আলো কেবল একটি বস্তুগত বিষয় নয়, বরং তা মানব জীবনে, সংস্কৃতিতে, ধর্মে, নৈতিকতায়, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনায় একটি অতল প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ, জীবনের অনিশ্চয়তা, অজ্ঞতা, দুঃখ, জরা প্রভৃতিতে পথপ্রদর্শক হচ্ছে আলো।
অনিশ্চয়তায় নিশ্চিন্তের আলো, অজ্ঞতায় জ্ঞানের আলো, দুঃখে সুখের আলো, জরায় সুস্থতার আলো। তার মানে এই আলো বহুমাত্রিক। অপরদিকে অন্ধকার অনিশ্চয়তা অজ্ঞানতা, ভয়, পাপ, দ্বেষ, অবরোধ, হতাশা প্রভৃতিতে বহুমাত্রিক। আর এই আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্বেই কেটে যায় মানব-জীবন।
দীপাবলি অর্থ আলো বা প্রদীপের সারি। দীপাবলিতে প্রজ্বলত শত-সহস্র আলোক শিখা অন্ধকার দূরীভূত করে। অর্থাৎ, দীপাবলির উৎসব হচ্ছে—আলো ছড়িয়ে দেওয়ার উৎসব। দীপাবলির সঙ্গে বেশ কয়েকটি পৌরাণিক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। যেমন—রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষণের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের সময় উদযাপিত আলোক উৎসব। নরকাসুরে বিনাশ ও বন্দিদের মুক্তি উৎযাপনের আলোক উৎসব প্রভৃতি।
দার্শনিকভাবে প্লেটোর আলোকবাদে বাস্তবের সত্তা, মূল আলোর বিশ্ব দ্বারা প্রকাশ পায়। আর এই আলোকেই দৃষ্টির চোখ অনুধাবন করে। ভারতীয় দর্শনে জ্ঞান ও অজ্ঞান যথাক্রমে আলোর অভ্যুত্থান ও তিমির অন্ধকারকে নির্দেশ করে। বৌদ্ধিক দর্শনে অন্তর জ্যোতি- সাম্য, নির্বাণ বা প্রজ্ঞার আলো যা, বাহ্যিক অন্ধকারকে অতিক্রম করার একটি উপায়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, অনেক ধর্ম ও আধ্যাত্মিক ধারায় মন্ত্র, ধ্যান ও সাধনার মাধ্যমে মানুষ নিজ অন্তরে আলো জ্বালায়। যেই আলো ভুল ধারণা, হতাশা এবং অপমানকে প্রতিহত করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যদি নিজের অন্তর আলো সম্পর্কে অবহিত হতে পারে তাহলে পৃথিবীতে সে নিজে যেমন পরম সুখপ্রাপ্তি করতে পারে, অপরদিকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারে হাজার রশ্মি। তাই এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দীপাবলির আলো শুধু বাহ্যিক প্রদীপ নয় বরং প্রতি জীবনে আলোর অভ্যুত্থান, সন্দেহ ও অন্ধকার থেকে মুক্তির একটি প্রতীকী ইচ্ছা।
...আলো বহুমাত্রিক। অপরদিকে অন্ধকার অনিশ্চয়তা অজ্ঞানতা, ভয়, পাপ, দ্বেষ, অবরোধ, হতাশা প্রভৃতিতে বহুমাত্রিক। আর এই আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্বেই কেটে যায় মানব-জীবন।
তাই বঙ্গে এখন যে বহুল প্রচলিত দীপাবলি উৎসব তা পালিত হয় মা কালীর আরাধনার দিন অর্থাৎ কালীপূজাতে। বাংলার বাইরে অবশ্য এখনো দীপাবলির উৎসবে রাবণ দহনের প্রচলন রয়েছে এবং অবাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কালীপূজা এবং সেই উপলক্ষে দীপাবলিই তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে বিবেচিত।
দীপাবলিতে বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করা হয়, আলোকসজ্জা করা হয়, আর সেই সাথে প্রজ্বলন করা হয় শত-সহস্র প্রদীপ। বাড়ির কোণে কোণে শোভা পায় প্রদীপ। বাড়ি, মহল্লা, শহর সেজে ওঠে আলোর সাজে। মাটির দীপ, মোমবাতি, বৈদ্যুতিক বাল্ব প্রভৃতি অন্ধকারকে প্রতিহত করে আলোর দিশা দেখায়।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, অন্ধকার মানুষকে ভয়, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিতে ফেলে দেয়। আলোর উপস্থিতি সেই ভয়কে হ্রাস করে, দৃষ্টিকে স্পষ্ট করে, সঠিক পথ নির্দেশ করে। তাই দীপাবলিতে একটি সংকল্পময় প্রচেষ্টার প্রতীক হিসেবে হাজার হাজার প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়—যা একসাথে অন্ধকারকে প্রতিহত করার বার্তা দেয়। অর্থাৎ, আমরা একসাথে আলো ছড়াব, অন্ধকার কাটাব।
সামাজিক দিক থেকে দীপাবলি এমন একটি সময়, যখন মানুষ নজর দেয় সৌজন্য, সহমর্মিতা, মিলন, সম্প্রীতি ও দান-পুণ্যের দিকে। এমনিতেই ধর্মের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে পুণ্যার্জন করা। আর ধর্মীয় কোনো পূজা বা উৎসব উপলক্ষে সেই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়।
কারণ উৎসব মানেই আলো, আর এর মধ্যে যে আলোকময়তা থাকে, তা ভালোকিছু করার মনোভঙ্গিকে প্রবল করে। তাই দীপাবলি একটি সাংস্কৃতিক, মানসিক ও সামাজিক আলো—যা মানুষের মধ্যে, সমাজে এবং মানব মনকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়।
আরও পড়ুন
তবে এই যে দীপাবলির আলোকবর্তিকার দ্বারা ঘনঘোর অন্ধকার দূর করার প্রয়াস এটি কিন্তু কেবল বস্তুগত নয় বরং প্রতীকীও বটে। এর প্রভাব কিন্তু বহুমাত্রিক। এই আলো কেবল বাহ্যিক অন্ধকারই দূরীভূত করে না, মানুষের মনের অন্ধকার অর্থাৎ সন্দেহ, ঘৃণা, দ্বেষ, অবিশ্বাস, ভয়, মোহ, পাপ, দ্বন্দ্ব, সংকীর্ণতা প্রভৃতি মানসিক আঁধারও দূরীভূত করে। অর্থাৎ, আলো এখানে জ্ঞান, সৌন্দর্য, উদারতা, ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস, প্রভৃতির রূপ পরিগ্রহ করে।
দীপাবলির আলো প্রতীকী হিসেবে ব্যক্তি নিজের অন্তরে ধারণ করে নিজেকে আরও উজ্জ্বল, পরিষ্কার ও মুক্ত করে তুলতে পারে অর্থাৎ, আলোর অভ্যুত্থান ঘটে মানুষের অন্তরে। আত্মজ্যোতি বা অন্তর রূপ আলো তখন মানুষের অন্তরে নেতিবাচক অজ্ঞতা রূপ আঁধারকে প্রতিহত করে।
সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এই আলো-আঁধারের তত্ত্ব স্পষ্ট। একটি সমাজে কতটা অন্ধকার আছে, তা নির্ভর করে কতটা আলো সেখানে প্রবাহিত। অর্থাৎ, ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা, শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের আলোই দুর্নীতি, বৈষম্য, অবিচার ও অশিক্ষাকে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করতে পারে। অনেক মানুষ বিভিন্ন উপায়ে সেই আলো খোঁজে।
শিক্ষা, ধর্ম, সৃজনশীলতা, সংস্কৃতি, ভালো কাজ, মানবিকতা এসবই আলো ছড়ানোর উপাদান। দীপাবলির আলোকে প্রতীক ধরে আমরা চাই যে—প্রতিজীবন যেন এক প্রদীপ হয়ে ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠে। মানুষের জীবনে সহমর্মিতা, দান, শিক্ষা, সত্য বোঝার প্রচেষ্টার মাধ্যমে যেন আলো আসে।
সামাজিক দিক থেকে দীপাবলি এমন একটি সময়, যখন মানুষ নজর দেয় সৌজন্য, সহমর্মিতা, মিলন, সম্প্রীতি ও দান-পুণ্যের দিকে। এমনিতেই ধর্মের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে পুণ্যার্জন করা। আর ধর্মীয় কোনো পূজা বা উৎসব উপলক্ষে সেই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণস্বরূপ—একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দান করেন—সেই আলো ছড়ান; একজন সমাজকর্মী অন্ধকার এলাকায় যেতে সাহস করেন; একটি সংগঠন দুর্ভিক্ষে দুর্যোগে দান করে; একজন সাংবাদিক সাহসিকতার সাথে সত্য সংবাদ উপস্থাপন করেন; একজন ডাক্তার দুর্গম এলাকায় চিকিৎসা প্রদান করেন; একটি সুশাসনব্যবস্থা দুর্নীতি ও অন্যায়কে নিয়ন্ত্রণ করেন—এই সবকিছুই আলোর বিচ্ছুরণ। এই ভাবনায় দীপাবলির আলো শুধু পরিবর্তনের প্রতীক নয়-সক্রিয় কর্মের আহ্বান।
তবে আলোকে শুভ ও অন্ধকারকে অশুভ হিসেবে দেখা প্রচলিত থাকলেও, অনেক সময় অধিক আলো দৃষ্টি ঝাপসা করে দেওয়ারও কারণ হতে পারে। কারণ সব ছায়াই আলো থেকেই উৎপন্ন হয়! অপরদিকে গভীর চিন্তা, বিশ্রাম, অন্তর্মুখী মনন প্রভৃতির জন্য আমাদের নির্জনতা ও অন্ধকারের প্রয়োজনও পড়ে।
তাই আলো ও অন্ধকারকে শুধুমাত্র শুভ ও অশুভর দ্বৈরথ হিসেবে সবসময় কল্পনা করা দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা হিসেবেও পরিচিত হতে পারে। তবে প্রতীকীর দিক থেকে আলো ও অন্ধকার তত্ত্ব একটি শক্তিশালী চেতনা জাগ্রত করার উদ্দেশ্য বহন করে। আর তাই আলোর সন্ধানে যে সক্রিয় কর্মস্পৃহা তা নানাভাবে বাঁধার সম্মুখীন হতে পারে।
যেমন-মানসিক অবস্থা, উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, অর্থ, অবকাঠামো ও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা, সমাজে বিরোধ, সহিংসতা, স্বার্থপরতা, মিথ্যাচার প্রভৃতির কারণে আলোর বিচ্ছুরণে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এই চ্যালেঞ্জগুলো অগ্রাহ্য করলে আলো দ্রুত নিভে যেতে পারে, কিংবা অন্ধকার আরও ঘনঘোর হতে পারে।
তাই ‘দীপাবলির দীপের আলো দূর করে দিক আধার কালো’—এই ধারণাটি কেবল একটি নিষ্পত্তি নয়, এটি একটি চলমান সংগ্রাম, সচেতন প্রচেষ্টা এবং প্রতিনিয়ত নবায়নযোগ্য একটি মানসিক চেতনা।
‘দীপাবলির দীপের আলো’ প্রকৃত অর্থে একটি উৎসবমাত্র নয়। এটি একটি চেতনা, অভিপ্রায়, নির্দেশ ও প্রতিজ্ঞা যে, আমাদের অন্ধকারকে শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে নয়, অভ্যন্তরীণ, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও নৈতিকভাবে প্রতিহত করতে হবে। ‘দূর করে দিক আঁধার কালো’—আমাদের মনে করিয়ে দেবে, অন্ধকার স্বয়ং ক্রমহ্রাস পাবে, যদি আমরা আলোর দিকে ধীরে ধীরে ধাবিত হই।
সেই আলোর বীজ মানুষের অন্তরাত্মায় পুঁতে দিতে হবে—যতটা আমাদের জীবনে ততটাই সমাজে, রাষ্ট্রে, আর, এর ফলে আমাদের আশা ও কর্ম মিলিত হয়ে ব্যক্তিজীবন সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অনুকারকে ধীরে ধীরে চিরতরে দূরীভূত করে দেবে। জীবন হবে মঙ্গলময়, আনন্দময়। সবশেষে বলতে চাই—দীপাবলির আলোয় আলোকিত হোক বসুন্ধরা, দূর হোক যত আঁধার ও মনের কালিমা।
ড. সঞ্চিতা গুহ : অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
