তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান : আশা ও আশঙ্কা

এই সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য আলোচিত হচ্ছে। কেউ কেউ দাবি করছেন যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত না হলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসা সম্ভব হতো না। এ বক্তব্যে সত্যের একটি বড়ো অংশ নিহিত রয়েছে, যা অস্বীকার করা যায় না। একই সঙ্গে এটিও সমানভাবে সত্য যে, এই বাস্তবতা হঠাৎ করে বা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক লড়াই, দমন-পীড়ন, আন্দোলন, নিপীড়ন সহ্য করার ইতিহাস এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী জনমত গঠনের জটিল প্রক্রিয়া। জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল সেই প্রক্রিয়ার বিস্ফোরণ, কারণ নয় বরং দীর্ঘকালীন কারণগুলোর যৌথ ফলাফল।
বহু বছর ধরে বাংলাদেশে একটি ভয়ভিত্তিক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যেখানে ভিন্নমত প্রকাশ ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করা, মামলা, গ্রেপ্তার, গুম, হামলা এসব ছিল দৈনন্দিন বাস্তবতা। এই পরিস্থিতিতে অনেক রাজনৈতিক দল প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে নীরবতা বা গোপন অবস্থানকে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। কেউ কেউ আপসের পথ বেছে নিয়েছে, কেউ আবার রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে সরে গেছে। তবে এই ভয়ের পরিবেশেও একটি রাজনৈতিক শক্তি প্রকাশ্য রাজনীতির পথেই টিকে থাকার চেষ্টা করেছে, মাঠে থেকেছে এবং তার মূল্যও দিয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা ধারাবাহিকভাবে মামলা-হামলা, কারাবরণ এবং নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই দীর্ঘ সহনশীলতা এবং দৃশ্যমান প্রতিরোধই ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদবিরোধী জনমতের ভিত্তি গড়েছে।
এই জনমত কোনো একক দিন বা এক মাসের কর্মসূচির ফল নয়। এটি ছিল মানুষের জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা, অপমান এবং অসহায়তার প্রতিফলন। মানুষ দেখেছে তারা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে না, ভোট দিতে পারছে না, মত প্রকাশ করতে পারছে না। রাষ্ট্রের ভেতরে এক ধরনের “দ্বিতীয় রাষ্ট্র” তৈরি হয়েছিল, যেখানে আইনের শাসন ছিল নির্বাচনী সুবিধা ও রাজনৈতিক আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। এই বাস্তবতা থেকেই ফ্যাসিবাদবিরোধী মানসিকতা সমাজের গভীরে প্রবেশ করেছে। বিএনপির আন্দোলন, কর্মসূচি ও মাঠপর্যায়ের উপস্থিতি সেই মানসিকতাকে রাজনৈতিক ভাষা, দিকনির্দেশনা ও সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
জুলাই আন্দোলন এই প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়। এটি ছিল জমে থাকা অসন্তোষের বিস্ফোরণ যেখানে ছাত্র, তরুণ, নারী, শ্রমজীবী মানুষ এবং মধ্যবিত্ত সবাই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হয়েছিল। আন্দোলনের পেছনে কিছু মানুষের স্বতন্ত্র ভূমিকা থাকলেও, এটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা বাস্তবসম্মত নয়। তবে এটিও সত্য যে, ফ্যাসিবাদবিরোধী জনমত যা আগে থেকেই সমাজে গড়ে উঠেছিল, সেটিই জুলাই আন্দোলনের প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আর এই জনমত গঠনে বিএনপির ভূমিকা অস্বীকার করা মানে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কিছু পরিবর্তন আসে। মানুষ দীর্ঘদিন পর আশার আলো দেখতে শুরু করে। অনেকে মনে করেছিলেন, এবার হয়ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে আসবে, রাজনীতি হবে আরও সহনশীল, অর্থনীতি হবে সাধারণ মানুষের কল্যাণমুখী। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নতুনভাবে শঙ্কা দেখা দেয়। ফ্যাসিবাদের বিদায়ের পর যেন আরেক ধরনের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই ধরনের অভিযোগ এবং আশঙ্কা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। ভিন্নমতকে অবজ্ঞা এবং প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা আবারও দৃশ্যমান হচ্ছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য হলো, এই পরিবর্তনের পরও দেশের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো সুস্পষ্ট কোনো কার্যকর রূপরেখা পায়নি। রাজনৈতিক আদর্শের নামে সমাজে বিভাজনের সৃষ্টি হচ্ছে। দলীয় পরিচয়, মতাদর্শ বা ব্যক্তিগত অবস্থানের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করা হচ্ছে। এই বিভাজন শুধু রাজনীতির মাঠেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমাজ, পরিবার ও সামাজিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলছে। সহনশীলতা এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, যা একটি সুস্থ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। অর্থনীতি বিকশিত হওয়ার পরিবর্তে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও আঞ্চলিক স্বার্থের বলয়ে আবদ্ধ হয়েছে। বৈষম্য বাড়ছে, কর্মসংস্থানের সংকট রয়ে গেছে, দ্রব্যমূল্যের চাপ সাধারণ মানুষের জীবন ক্রমেই কঠিন করে তুলছে। যখন রাজনীতি ও অর্থনীতি কয়েকটি গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হয়, তখন সাধারণ মানুষের মুক্তি কেবল স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকে।
এই বাস্তবতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্ন। নির্বাচনই পারে রাজনৈতিক বিভাজন কমাতে, জনগণের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটাতে এবং ক্ষমতার বৈধতা নিশ্চিত করতে। দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষের মধ্যে গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। সেই হতাশা দূর না হলে কোনো আন্দোলন বা পরিবর্তন টেকসই হবে না। তাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠা জরুরি।
গণতন্ত্র মানেই মতভেদের সহাবস্থান। সবাই একই কথা বলবে, একই পথে হাঁটবে - এমনটি কখনো বাস্তবসম্মত নয়। মতভেদ থাকবে, বিতর্ক থাকবে এবং দ্বন্দ্ব থাকবে কিন্তু সেটি যেন শত্রুতায় রূপ না নেয়, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মানেই শত্রু এই মানসিকতা থেকে বের হওয়া না পারলে নতুন ফ্যাসিবাদ জন্ম নিতেই থাকবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্মরণ করিয়েছে যে, মানুষের শক্তি অবহেলা করা যায় না। এটি একটি সতর্কবার্তাও। যদি সেই শক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত না করা হয় এবং গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের কাঠামো শক্তিশালী না করা হয় তবে পরিবর্তনের আশা দ্রুতই হতাশায় পরিণত হতে পারে। দেশের ভবিষ্যৎ কোনো একক দল, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে নিরাপদ নয়; এটি নিরাপদ হবে তখনই, যখন জনগণের মতামতকে প্রকৃত অর্থে সম্মান করা হবে।
আজকের বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে অতীতের দমন-পীড়নের স্মৃতি, অন্যদিকে একই ধরনের শাসনব্যবস্থার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা। এই দুইয়ের মাঝখানে সাধারণ মানুষ এখনো প্রকৃত মুক্তির অপেক্ষায়। এই অপেক্ষা যেন দীর্ঘ না হয়, সেটিই সবার কাম্য। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সহযোগিতার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, তবে দেশ নতুনভাবে এগিয়ে যেতে পারে।
শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত একটাই। সব মত এবং পথের মানুষকে নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। মতভেদ থাকবে, তর্ক থাকবে, সমালোচনা থাকবে; কিন্তু সেই ভিন্নতার মধ্যেই ঐক্যের সুর খুঁজে নিতে হবে। দেশ গড়াই হোক আমাদের সম্মিলিত উদ্দেশ্য, আর গণতন্ত্র ও মানবিক মর্যাদা হোক চূড়ান্ত গন্তব্য।
প্রফেসর ড. খালিদুর রহমান ।। পরিসংখ্যান বিভাগ ।। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট