ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে করণীয়
![ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে করণীয়](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2021July/dengu-kabirul-bashar-20210726081917.png)
করোনা মহামারির মধ্যেই আরেকটি স্বাস্থ্য সংকট শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে শতাধিক মানুষ। গত ২৫ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে নতুন করে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে ১০৫ জন। এই ৪১টি হাসপাতাল ছাড়াও অন্যান্য হাসপাতালে এবং বাসায় রোগী আছে এর প্রায় তিন গুণ।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে এই সতর্কবার্তা আমি জুনের শুরুতে দিয়েছিলাম। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তা প্রচারিত হয়েছে। আমার গবেষণা দলের ফলাফল অনুযায়ী, ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব ডেঙ্গু ছড়ানোর উপযোগী মাত্রায় রয়েছে এবং এটি ধীরে ধীরে বাড়ছে। জরুরি ভিত্তিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে হাজার হাজার মানুষ।
করোনার মতো ডেঙ্গু অদৃশ্য শক্তি নয়। ডেঙ্গু একটি দৃশ্যমান শক্তি, যাকে মোকাবিলা করা কঠিন নয়। ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে আর এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণও সহজ, কারণ এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে বংশবিস্তার করে। জমা পানির পাত্র অপসারণ কঠিন কোনো কাজ নয়। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশার কীটনাশক সহনশীল, তাই কীটনাশক দিয়েও এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ।
জরুরি ভিত্তিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে হাজার হাজার মানুষ। করোনার মতো ডেঙ্গু অদৃশ্য শক্তি নয়। ডেঙ্গু একটি দৃশ্যমান শক্তি, যাকে মোকাবিলা করা কঠিন নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল এবং মারা গিয়েছিল। সেই বছরই এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আমি দিয়েছি। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি।
জরুরি পদক্ষেপ:
ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ডকে দশটি ব্লকে ভাগ করে দশটি টিম গঠন করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। এই দশটি টিমের প্রতিটিতে স্থানীয় তরুণ সমাজ সেবকদের দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মীদেরকে যুক্ত করে দিয়ে এডিস মশার প্রজনন পাত্র ধ্বংস ও অপসারণের পাশাপাশি উড়ন্ত মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
প্রতিটি টিমকে নিশ্চিত করতে হবে যেন তার ব্লকে কোনো এডিস মশা জন্মানোর পাত্র না থাকে। প্রতিটি ব্লকের ডেঙ্গু পরিস্থিতি মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশনের জন্য সিটি করপোরেশনের সেন্ট্রাল টিম থাকতে পারে। যে ব্লকে ডেঙ্গু রোগী সবচেয়ে কম হবে তাদেরকে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে কাজে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা:
আমি বারবার বলে এসেছি, অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে পাঁচ থেকে দশ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সারা বছরব্যাপী চলমান থাকতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মহাপরিকল্পনায় সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি মূল পিলারকে একসাথে সারাবছর বাস্তবায়ন করতে পারলেই এডিস মশাবাহিত রোগ যেমন, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি পিলার:
১. পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ: পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যার কারণে মশার জন্ম হয়। পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল কমানো এবং ধ্বংস করে মশাকে সহজভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ জলাধার পরিষ্কার এবং বিভিন্ন পানির পাত্র অপসারণ ও পরিষ্কার রাখা।
সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব রাস্তাঘাট, উন্মুক্ত স্থান, সরকারি স্থাপনা, বাস টার্মিনালগুলোতে এডিস মশার প্রজনন বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা আর নগরবাসীর দায়িত্ব তার বাড়ি এবং আঙিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয় তা নিশ্চিত করা।
২. জীবজ নিয়ন্ত্রণ: উপকারী প্রাণীর মাধ্যমে মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। উদাহরণস্বরূপ গাপ্পি মাছের কথা আমরা জানি যার মাধ্যমে পরিবেশগতভাবে অল্প খরচে টেকসই মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কপিপোড (Copepod) এবং এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার ও পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। এ জাতীয় জীবজ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
৩. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড এবং এডাল্টিসাইড কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রতিটি কীটনাশকের একটি নির্দিষ্ট ডোজ এবং কত দিন পরপর কোন মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে তারও একটি নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক কীটনাশক ব্যবহার করলে অবশ্যই মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
৪. মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের অংশগ্রহণ: জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া দুষ্কর। তাই এ প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে সামাজিক সংগঠনগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে এ কাজ করানো যেতে পারে।
সংকটময় পরিস্থিতিতে কাউকে দোষারোপ না করে যার যার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব রাস্তাঘাট, উন্মুক্ত স্থান, সরকারি স্থাপনা, বাস টার্মিনালগুলোতে এডিস মশার প্রজনন বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা আর নগরবাসীর দায়িত্ব তার বাড়ি এবং আঙিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয় তা নিশ্চিত করা।
সিটি করপোরেশন ও নগরবাসীর সম্মিলিত কার্যক্রমই পারে ডেঙ্গু সমস্যার সমাধান করতে। করোনার মহামারির মধ্যে যেন ডেঙ্গু সংকট ভয়াবহ হয়ে না ওঠে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে চলুন একসাথে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হয়ে নিজের পরিবার ও দেশকে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু মুক্ত রাখি।
অধ্যাপক ড. করিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়