আফগানিস্তান : দৃষ্টি দূরে থাকুক, নজর কাছে থাকুক

Syed Ishtiaque Reza

৩১ আগস্ট ২০২১, ১০:২৯ এএম


আফগানিস্তান : দৃষ্টি দূরে থাকুক, নজর কাছে থাকুক

‘এই তালেবান সেই তালেবান নয়, এরা নব্বইয়ের দশকের সেই তালেবানের মতো জঙ্গি নয়, অশিক্ষিত নয়, গোঁড়া নয়’ এখন পর্যন্ত এমন একটা আত্মপ্রসাদের ভেতর আছে আমাদের লিবারেল সেক্যুলার সম্প্রদায়। তাই আফগানিস্তানে ক্ষমতার পরিবর্তন নিয়ে এক প্রকার নীরবতাই পালন করছে বাংলাদেশের উদারনৈতিক রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজ। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিটি শাখায় উচ্ছ্বাসের প্রকাশ দেখাচ্ছে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো। তারা বরং চাইছে, তালেবানরা সেই পুরোনো চেহারায় ফিরুক।

আফগানিস্তান সম্পূর্ণভাবে দখল করে সন্ত্রাসের শব্দ তুলে ফেরেনি তালেবান। এখন পর্যন্ত বেশ সংযত আচরণ তাদের। কাবুল থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাবর্তন ঘটছে, মানুষ পালাচ্ছে তালেবানরা কোনো বাধা দেয়নি। তবে তাদের উপর হামলা করেছে আইএস, সেখানে আবার তালেবানরাও মারা গেছে। এমন সব ছবির মাঝে ভাবনা একটাই প্রজাপতির মতো নির্ভার থাকবে কি না দক্ষিণ এশিয়া।

আমেরিকা হেরেছে, ভারত বলতে গেলে কূটনীতিতে একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চীন, পাকিস্তান, ইরান এবং রাশিয়া তালেবানদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই পরিবর্তনগুলো নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিতে, বিশেষ করে দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায়।

আন্তর্জাতিক মাধ্যমে যেসব খবর আসছে, তাতে স্পষ্ট হচ্ছে যে, তালেবানদের সাথে আবারও পাকিস্তানের মদদপ্রাপ্ত হাক্কানি এবং অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। ভারত মনে করে, সন্ত্রাসের যে উগ্রতা দেখা যাচ্ছে, তা পাকিস্তানের সমর্থন ছাড়া ঘটার কথা নয়। কিন্তু পাকিস্তান এখনো পর্যন্ত খুব সতর্ক প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছে।

আফগানিস্তানের মানুষ ৪২ বছর ধরে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত। যারা তালেবান আসায় পালাতে পেরেছে তারা প্রাণে বেঁচেছে। কিন্তু যারা রয়ে গেছে তাদের বাঁচতে হবে।  

কাবুল দখলের সময় ঢাকার পুলিশ প্রধান বলেছিলেন, তালেবানদের সঙ্গে যোগ দিতে যারা বাংলাদেশ ছাড়ছেন তাদেরকে আর ঢাকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না এবং ঢুকলেই তাদের গ্রেফতার করা হবে। তবে তার দুদিন পরই সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের তালেবান হামলা নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন নয়, ঐ হামলার জেরে বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থানের কোনো আশঙ্কাও নেই। বাংলাদেশের গোয়েন্দা বাহিনী কঠোর নজরদারি রাখছে বলেও জানান তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন, আফগানিস্তান বাংলাদেশ থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে, আর সে দেশের সাথে বিমান চলাচলসহ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সুতরাং সেখানে বাংলাদেশ থেকে কারও যাওয়ার সুযোগ নেই।

দূরত্ব অবশ্যই একটি ইস্যু। কিন্তু আমরা জানি, আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি ভাবাপন্ন দলের কর্মীরা আফগানিস্তানে লড়াই করতে গিয়েছিল এবং তাদের কেউ কেউ ফিরে এসে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছিল, রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিল।

তালেবানরা আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করায় বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে একটা বিচার বিশ্লেষণ সব স্তরেই আছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চয়ই সজাগ আছে।

তালেবানদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো নতুন করে সংগঠিত বা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কি না, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজরদারি প্রয়োজন। যারা এ বিষয়ে খোঁজ খবর রাখেন তাদের প্রতিক্রিয়া দেখলাম অনেকটা এমন যে, আফগানিস্তানে তালেবানের শাসন ফিরে আসায় বাংলাদেশকে বিপদ মোকাবিলার কথা মাথায় রাখতে হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী দু’জনেই সতর্ক মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশ সাবধানতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর রাখছে। তালেবানদের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চয়ই অনেক ভেবেচিন্তে করা হবে।

আফগানিস্তানের মানুষ ৪২ বছর ধরে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত। যারা তালেবান আসায় পালাতে পেরেছে তারা প্রাণে বেঁচেছে। কিন্তু যারা রয়ে গেছে তাদের বাঁচতে হবে। আর বাঁচতে হলে যুদ্ধ, লড়াই, দ্বন্দ্ব থামাতে হবে। আর সেটা করতে হলে তালেবানদেরও যেমন নিজেদের আচরণ বদলাতে হবে, তেমনি অন্য যেসব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় আছে তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

যদি আফগান ভূখণ্ডে বসবাসকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে একটি সর্বজনীন সরকার গঠন করতে পারে তালেবান, তাহলে বাংলাদেশ কি করবে সেটা তখনকার প্রেক্ষাপটেই ছেড়ে দিতে হবে।

আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক থাকলেও দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। নেই কোনো ব্যবসায়ী সম্পর্কও। কিন্তু বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠীর ভালোবাসার দৃষ্টি যে সেদিকে আছে সেটা নিশ্চিত। এখনই সরাসরি কোনো প্রভাব না পড়লেও তরুণ সমাজসহ সমাজের নানা শ্রেণি পেশার মধ্যে আদর্শিক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে সেখানে নারীদের অধিকার কেড়ে নেওয়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা, পুরুষদের এক মুঠো দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক করার মতো ইসলামি শাসন কাঠামোর নামে জবরদস্তিমূলক অনেক কিছু এদেশে গোষ্ঠী ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুশীলন শুরু হতে পারে।

আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক থাকলেও দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। নেই কোনো ব্যবসায়ী সম্পর্কও। কিন্তু বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠীর ভালোবাসার দৃষ্টি যে সেদিকে আছে সেটা নিশ্চিত।

দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে, এই রাজনীতি যারা করে, সেই নেতৃত্বের মধ্যে আদর্শিক মিলটাই বড় যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। এসব জঙ্গি দলে দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করে স্থানীয় নেতৃত্বের নির্দেশে, তবে তাদের আসল মুরব্বি তারাই, যারা জঙ্গিবাদকে লালন করছে বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে। কার মগজ কীভাবে ধোলাই করা হচ্ছে, সেটা বলা মুশকিল।

হলি আর্টিজান বেকারি বা কল্যাণপুরসহ বেশ কিছু হামলার পর তরুণদের যেসব অডিও ও ভিডিও ক্লিপ পাওয়া গেছে সেগুলোতে দেখা যায় তারা সরকার, গণতন্ত্র, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যেমন বলেছে, তেমনি নিজেদের পিতামাতাকেও মুরতাদ ও কাফের বলতে ছাড়েনি। 
মনস্তত্ত্বের এই পরিবর্তন নিয়েই ভাবা দরকার বেশি। এদেশেই এক সময় স্লোগান উঠেছিল, ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। মনে রাখা দরকার সেই গোষ্ঠী এখনো সক্রিয়।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের নানা প্রান্তে উগ্রবাদীদের আস্ফালন ও তাণ্ডব দেখেছি। এরা সেই গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশে তালেবানের শাসন চায়। সেই তাণ্ডব, তার প্রতি বিএনপি-জামায়াতের অকুণ্ঠ সমর্থন, কোনো কোনো এলাকার অন্য রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ এবং এমনকি খোদ সরকারি দল আওয়ামী লীগের কিছু অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীর প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ নতুন বাস্তবতা আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে। তাই কাবুলের দিকে দৃষ্টি থাকুক, নিজের ভূমিতে নজর থাকুক।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি

Link copied