শেখ হাসিনার কাছে চিঠি
সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে ততদিনে আপনার আর হারানোর কিছু বাকি ছিল না, নতুন করে পাওয়ারও ছিল না। বাবা-মা, তিন ভাই, ভাইদের নবপরিণীতা স্ত্রী’রা, চাচা, ফুফাতো ভাই-ভাবী, এমনকি কাজের লোকটাও রেহাই পায়নি। তবুও আপনি ফিরে এসেছিলেন জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করতে, পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে, খেই হারানো নৌকার বৈঠা ধরতে।
১৭ মে ১৯৮১, ঢাকা। সেদিন কালবৈশাখী ছিল, বাংলার ঝোড়ো আকাশ-বাতাস যেন খুনিদের সেদিন বার্তা দিয়েছিল, তোমাদের জুলুমের দিন শেষ, তোমরা দিন গুনতে শুরু করো হে অত্যাচারীর দল। আপনি পার্টির দায়িত্ব নিলেন, সেখানেও আপনাকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল নানা চ্যালেঞ্জের। কিন্তু আপনি যেদিন ফিরে এসেছিলেন সেদিন কালবৈশাখীর মধ্যে আপনার ভাইয়েরা আপনাকে কথা দিয়েছিল, ‘শেখ হাসিনা ভয় নাই, আমরা আছি লাখো ভাই।’
আপনার আদরের কামাল, জামাল, রাসেলরা যেন ফিরে এসেছিল এই ভাইদের মাঝে। এই ভাইয়েরা তাদের কথা রেখেছিল আপনার প্রতি শত্রুর প্রতিটি আঘাতে। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দান, গুলিস্তানের ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ; প্রতি বুলেট আর গ্রেনেডের সামনে আপনার এই ভাইয়েরা বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ যেন পিতাকে রক্ষা না করতে পারার আজন্ম প্রায়শ্চিত্ত।
জাতির পিতাকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা, কিন্তু আপনাকে আমরা হারাতে দেবো না। আপনি জাতির পিতার রেখে যাওয়া পবিত্র আমানত। এই আমানতকে জীবন দিয়ে বারবার রক্ষা করেছে পিতার আদর্শিক সন্তানেরা, আপনার প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভাইয়েরা। দুই খুনি স্বৈরাচার সেনাশাসকের পতনের পর দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে এলো ঠিকই, কিন্তু ততদিনে ভোটের বাক্স চলে গিয়েছে লুটেরা মুনাফাখোরদের হাতে। আপনি অনেক চেষ্টা করলেন প্রকৃত রাজনীতিবিদদের ভোটের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে, তাদের প্রার্থীও করলেন, কিন্তু কালো তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজদের টাকার কাছে সামান্য কিছু ভোটের ব্যবধানে সেদিন বাংলার মসনদ থেকে দূরে থাকতে হলো, দীর্ঘায়িত হলো পিতৃহীন এই ভূতুড়ে বাংলার বঞ্চনার কালো মেঘ। কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করা লাগল না, দু’চোখে যার বিশ্বজয়ের নেশা তাকে কি দাবায়ে রাখা যায়! সাল ১৯৯৬, আপনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন, ২১ বছর পর এই অভাগা বাংলায় বঙ্গবন্ধুর নামটি প্রকাশ্যে উচ্চারিত হলো, সরকারি দফতরে উঠল প্রাণহীন পিতার নির্বাক ছবি।
আপনি মমতাময়ী জননী, নিরহংকারী ভগিনী, পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বয়স্ক কাউকে দেখলে আপনি উঠে দাঁড়ান, জেলার বৃদ্ধ সভাপতিকে দেখলে নিজে চেয়ার এগিয়ে দিতে উদ্যত হন। তীব্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝেও জনগণ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হতে চান না। পিতার এই গুণগুলো আপনি হুবহু পেয়েছেন। আপনি যখন কথা বলেন তার মধ্যে স্পষ্টবাদিতা থাকে, এজন্য আপনাকে বহুবার সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু আপনি বলেছেন, ‘যদি আলোচিত হতে চাও কখনো সমালোচনাকে ভয় করো না।’ আপনি এ-ও বলেছেন, ‘যে গাছের ফল মিষ্টি হয়, সে গাছে ঢিল বেশি পড়ে।’ আপনার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা টের পাওয়া যায় এই কথাগুলোর মধ্যে। আপনি ধৈর্য ধারণ করলেন, অভিমান-রাগ লুকাতে শুরু করলেন। নীলকণ্ঠ হয়ে বিষ হজম করতে শিখলেন, মহামায়ার মতো দশটি হাতে দশ দিক সামলানো রপ্ত করলেন। সারাদেশের মানুষ যখন ঘুমিয়ে যায় আপনি তখনো জেগে থাকেন আগামীর চিন্তায়।
পিতার মতোই অতীতে আপনি আপোষ করতে জানেননি, তাই আপনাকে আন্তর্জাতিক চক্রান্তে হারিয়ে দেওয়া হলো পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে। আপনি দেখলেন, বুঝলেন, পুড়লেন, খাঁটি হলেন। ২০০১-০৮ এই সাতটা বছরে আপনি যা শিক্ষা নিলেন তা আপনাকে এনে দিয়েছে একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের স্বীকৃতি।
যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় পিতৃহন্তার প্রতিশোধ নিয়ে আমাদেরকে লজ্জার হাত থেকে রেহাই দিলেন। আপনি একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করলেন, আন্তর্জাতিক মোড়লপনার তোয়াক্কাও করলেন না। বিষধর সাপকে বশে আনতে, পাতালপুরীর আততায়ীদের চক্রান্ত প্রতিরোধে আপনি ছাড়িয়ে গেলেন আপনার পিতাকেও। যারা আপনার ধ্বংস চেয়েছিল তারা আপনাকে ‘জননী’ ডাকল, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির প্রশ্রয়ে যারা আপনাকে বিনাশ করতে চাইল, আপনি তাদের শোধরানোর সুযোগ দিলেন। বিষদাঁত তাদের ভেঙেছেন ঠিকই, কিন্তু এই সর্পসন্তানরা একদিন আবার ছোবল দেওয়ার সক্ষমতা পাবে। ওরা ক্ষমতা দখলের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে আমাদের মগজ দখলের দখলদারিত্বে নেমেছে, ভয়টা থেকেই যায়।
আপনি শিখে গিয়েছেন কিভাবে আপোষ করেও আপোষহীন থাকা যায়, আপনি দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে বারবার পরাজিত হয়েও শেষ পর্যন্ত মাথা উঁচু করে অপরাজিত থাকা যায়। শুধু প্রধানমন্ত্রী নয়, একজন সুদক্ষ কূটনৈতিকের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সকল রাজনৈতিক বলয়ের সাথে বিস্ময়কর সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। আপনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা হয়ে উঠেছে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুপাঠ্য, জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত।
প্রিয় আপা, আপনাকে কেন জানি শুধু প্রধানমন্ত্রী মনে হয় না। আপনি আমাদের হারিয়ে যাওয়া পিতার বড় সন্তান, পিতার অবর্তমানে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া একটা একান্নবর্তী পরিবারের ত্রাণকর্তা। আপনি শতায়ু হন, আমাদের বাতিঘর হয়ে পথ দেখান। আপনার দৃষ্টিসীমা ধরে হেটে যেতে চাই এই জনপদের শেষ দুঃখী মানুষটির কাছে। আপনার ভালোবাসায় আমরা মত্ত।
শুভ জন্মদিন দেশরত্ন।
হামজা রহমান অন্তর ।। ছাত্রনেতা।