চীনে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দান ব্যবস্থা ও দশ বছরের লিন ওয়েনচুনের কথা

K M Alimul Hoque

০৩ নভেম্বর ২০২১, ০৪:৫৩ পিএম


চীনে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দান ব্যবস্থা ও দশ বছরের লিন ওয়েনচুনের কথা

তখন ঢাকার নটরডেম কলেজে পড়ি। কলেজে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম চলছে। নাম লিখিয়ে নির্ধারিত বেডে শুয়ে পড়লাম। ডাক্তার এসে আমার লিকলিকে শরীর খুঁটিয়ে দেখলেন, প্রশ্ন করলেন: ‘ওজন কত?’ বললাম, ‘একশ পাউন্ডের বেশি।’ ডাক্তার সন্দেহের দৃষ্টিতে আমাকে আবারও পরখ করে বললেন, ‘মনে তো হচ্ছে না!’ আমি নির্বিকার। অনেকটা দ্বিধা নিয়েই ডাক্তার আমার হাতে সুই ফোটালেন। প্লাস্টিকের নলের ভেতর দিয়ে রক্তের ধারা ছুটল ব্যাগ লক্ষ্য করে। এবার ডাক্তার খানিকটা হেসে বললেন, ‘রক্তের ফ্লো বেশ ভালো। তবে, নিয়মিত রক্ত দিতে হলে, শরীরের ওজন বাড়াতে হবে।’

ওজন না বাড়লেও, মাঝে মাঝে রক্ত দিতাম তখন। দু’একবার হাসপাতালে গিয়েও রোগীদের রক্ত দিয়েছি। রক্তদানের পর মনে একটা বেশ ভালো অনুভূতি হয়; কিছু একটা ভালো করার অনুভূতি। কলেজ জীবন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর, একদিন সন্ধানীর খাতায় নাম লেখালাম স্বেচ্ছায় চক্ষু দাতা হিসেবে। ওরা আমাকে একটা কার্ড দিল। আমি মারা গেলে সন্ধানীর লোকজন এসে আমার চোখের কর্নিয়া নিয়ে আলো জ্বালাবে কোনো অন্ধের চোখে—এমনটাই কথা। এমন একটা সম্ভাবনার কথা ভাবতেও ভালো লাগে।

ভালো লাগে যখন শুনি একজনের দানকৃত অঙ্গ পেয়ে বেঁচে গেছেন আরেকজন। তেমনি একটি খবর পড়ে আবেগাপ্লুত হই ক’দিন আগে। বলা যায়, সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এই লেখা। মাত্র ১০ বছর বয়স ছেলেটির। নাম লিন ওয়েনচুন। পূর্ব চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের নানফিংয়ে ফুটফুটে ও বাহ্যিক দিক দিয়ে বেশ স্বাস্থ্যবান এই ছেলেটি তার বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে জীবন বাঁচিয়ে গেছে একজনের নয়, বরং ছয় ছয় জনের! সে নেই, কিন্তু তার ছোট্ট হৃদপিণ্ডটি ধুকপুক ধুকপুক করছে অন্য একটি শিশুর বুকে। শিশুটি বেঁচে আছে পিতা-মাতার কোল উজ্জ্বল করে। লিন ওয়েনচুনের ফুসফুস, কিডনি ও লিভার বাঁচিয়ে রেখেছে আরও পাঁচ ব্যক্তিকে।

এ সবের সূত্রপাত গত সেপ্টেম্বরে। এই মহামারির সময়ে কোভিড-১৯ নয়, বরং অন্য এক দুরারোগ্য ব্যাধি এপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়াতে (aplastic anemia)

স্পেনে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দানকারীর সংখ্যা ৪৬.৯১ জন।

আক্রান্ত হয় ওয়েনচুন। অনেকেই জানেন, আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রক্তকোষ সৃষ্টি হয়। পুরাতন রক্তকোষের জায়গা দখল করে এই নতুন রক্তকোষগুলো। এ জন্যই চিকিৎসকরা বলেন, স্বেচ্ছায় রক্তদান ব্যক্তির স্বাস্থ্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলে না। কারণ, রক্ত না দিলেও ব্যক্তির শরীরের পুরাতন রক্তকোষগুলো নতুন কোষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। সমস্যা হচ্ছে, এপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর শরীরে নতুন রক্তকোষ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ওয়েনচুনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। তাকে বাঁচানোর একমাত্র রাস্তা ছিল বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। কিন্তু সেটা করার সময়টুকুও পাননি চিকিৎসকরা। ১৯ অক্টোবর তার শরীরে ইন্ট্রাক্র্যানিয়াল রক্তক্ষরণ (intracranial hemorrhage) হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে চিকিৎসকরা ব্রেইন ডেড (brain dead) ঘোষণা করেন।

ছোট্ট ওয়েনচুনের পিতা-মাতা তাদের প্রিয় সন্তানের বিভিন্ন অঙ্গ দান করার সিদ্ধান্ত জানান রেড ক্রস সোসাইটিকে। একে একে ওয়েনচুনের বিভিন্ন অঙ্গ ৬ ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ওয়েনচুনের চিকিত্সা হচ্ছিল ফুচৌ সিয়েহ্য হাসপাতালে। ২৯ অক্টোবর হাসপাতালের স্বেচ্ছায় অঙ্গ দান সমন্বয়কারী জানান, ওয়েনচুনের হার্টটি অন্য একটি শিশুর বুকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং শিশুটি সুস্থ আছে। ওয়েনচুন মরে গিয়েও যেন বেঁচেই আছে!

ওয়েনচুনের বয়স হয়েছিল দশ বছর। ইতিহাস বলছে, ২০১৪ সালে একটি শিশুর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির শরীরে। শিশুটি বেঁচে ছিল মাত্র ১০০ দিন। জীবিত ব্যক্তিরাও অন্যের প্রাণ বাঁচাতে নিজেদের শরীরের অঙ্গ দান করে থাকেন। এক্ষেত্রে সবার আগে আসবে রোনাল্ড লি হ্যারিকের নাম। ১৯৫৪ সালে তিনি তার যমজ ভাই রিচার্ড লি হ্যারিককে একটি কিডনি দান করেন। রিচার্ড ভাইয়ের কিডনি নিয়ে ৮ বছর বেঁচেছিলেন। বলা বাহুল্য, সেটা ছিল পৃথিবীর প্রথম সফল কিডনি প্রতিস্থাপনের ঘটনা। সার্জারি করেছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত প্লাস্টিক সার্জন জোসেফ অ্যাডওয়ার্ড মারে (Joseph Edward Murray)। মারে ১৯৯০ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পান।

মারে কিডনি প্রতিস্থাপনে সফল হয়েছিলেন ১৯৫৪ সালে। সেই শুরু। তারপর থেকে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে, এক্ষেত্রে বোধ করি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন ওয়েনচুন বা রোনাল্ড লি হ্যারিকের মতো মানুষেরা। তাদের দানকৃত অঙ্গই অসংখ্য মানুষকে নতুন করে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছে ও দিচ্ছে বলা চলে। রোনাল্ডের মতো মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেও বটে। বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ অঙ্গ দান করছেন; কেউ জীবিতাবস্থায়, কেউ মৃত্যুর পর।

২০১০ সালে চীনা সরকার স্বেচ্ছায় অঙ্গ দান ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ২০১৪ সালে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দাতাদের নিবন্ধনের জন্য একটি ওয়েবসাইট খোলে সরকার...

স্বেচ্ছায় অঙ্গ দানের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে স্পেন (এ হিসাব অবশ্য ২০১৯ সালের)। সেদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দানকারীর সংখ্যা ৪৬.৯১ জন। পরের চারটি স্থান যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র (৩৬.৮৮ জন), ক্রোয়েশিয়া (৩৪.৬৩ জন), পর্তুগাল (৩৩.৮ জন) এবং ফ্রান্সের (৩৩.২৫ জন)। পরিসংখ্যানই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী স্বেচ্ছায় অঙ্গ দানের হার বেশি নয়। একটা উদাহরণ দিই।

২০১৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে এক লাখ কুড়ি হাজার রোগী ছিলেন, যাদের জীবন বাঁচানোর জন্য অন্যের শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অঙ্গ দাতার সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বস্তুত, আজও স্বেচ্ছা অঙ্গ দাতার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম, যদিও বিশ্বব্যাপী স্বেচ্ছায় অঙ্গ দানের পক্ষেই জনমত সোচ্চার।

স্বেচ্ছায় অঙ্গ দাতাদের সংখ্যা চীনেও ক্রমশ বাড়ছে। চীনে মানব অঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এদেশে, বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে, মানব অঙ্গ দান করা যায়। ২০১০ সালে চীনা সরকার স্বেচ্ছায় অঙ্গ দান ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ২০১৪ সালে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দাতাদের নিবন্ধনের জন্য একটি ওয়েবসাইট খোলে সরকার। ওয়েবসাইটে দাতারা নিজেদের নাম নিবন্ধন করাতে পারেন। আর দানকৃত মানব অঙ্গ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বণ্টন করা হয় ‘চায়না অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট রেসপন্স সিস্টেম’ দ্বারা। এক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি বা দুর্নীতির কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।

২০১০ সালে চীনে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দান ব্যবস্থা চালুর পর অঙ্গ দান ও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। বাড়ার এই গতি ছিল খুবই কম। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত চীনে মাত্র ৪৯৩৩টি ক্ষেত্রে মৃত অঙ্গ দাতার অঙ্গ অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে, এ সংখ্যা এরপর থেকে বাড়তে শুরু করে। বিশেষ করে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দাতার সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত গতিতে।

২০১৬ সালে ১৬৯,৮৬০ জন চীনা স্বেচ্ছায় অঙ্গ দাতা নাম নিবন্ধন করেন। এরপর থেকে এ সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২০২১ সালের জুনে চীনে নিবন্ধিত স্বেচ্ছায় অঙ্গ দাতার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ লাখের ওপরে। সমস্যা হচ্ছে, ২০১৫ সালের এক হিসাব অনুসারে, প্রতিবছর চীনে ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়, কিন্তু মাত্র ১০ হাজার মানুষ তা বাস্তবে পেয়ে থাকেন।

গণসচেতনতা বাড়াতে ও অঙ্গ দানের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সামাজিক আন্দোলন জরুরি।

স্বেচ্ছায় অঙ্গ দানের তুলনায় স্বেচ্ছায় রক্তদানে চীনারা অনেক বেশি এগিয়ে আছে। ১৯৯৮ সালে চীনে স্বেচ্ছায় রক্তদান আইন কার্যকর হয়। আইন অনুসারে, ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী স্বাস্থ্যবান নাগরিকরা স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে পারেন। চীনের সরকার স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের জন্য দেশব্যাপী ৪৫২টি রক্ত সরবরাহ কেন্দ্রও গড়ে তোলে। সেই থেকে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা যেমন ক্রমশ বেড়েছে, তেমনি স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মসূচির মাধ্যমে সংগৃহীত রক্তের পরিমাণও বেড়েছে। ১৯৯৮ সালে প্রতি ১০ হাজার চীনা গড়ে রক্ত দিয়েছেন ৪.৮ ইউনিট করে, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১১.১ ইউনিটে। অন্য হিসাবে, কোভিড মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালে এক কোটি ৫৫ লাখ ব্যাগ রক্ত দান করেছেন চীনারা এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৫১ লক্ষাধিক ইউনিট রক্ত দান করেছেন তারা।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন চীনে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের তুলনায় স্বেচ্ছায় অঙ্গ দাতাদের সংখ্যা এত কম? কীভাবে এ সংখ্যা প্রত্যাশিত হারে বাড়ানো যায়? স্বেচ্ছায় অঙ্গ দানের ব্যাপারে সমাজে বিদ্যমান ভুল বোঝাবুঝি বা প্রচলিত ভুল ধারণার উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটলেই স্বেচ্ছায় অঙ্গ দাতার সংখ্যা আরও দ্রুত বাড়বে।

গণসচেতনতা বাড়ানোর ওপরও তারা জোর দিচ্ছেন। গণসচেতনতা বাড়াতে ও বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থা উন্নত করতে, ২০১৫ সালের আগস্টে সরকার এ সংক্রান্ত প্রথম জাতীয় গাইডলাইনও প্রকাশ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণসচেতনতা বাড়াতে ও অঙ্গ দানের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সামাজিক আন্দোলন জরুরি। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো, বিশেষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। বস্তুত, শুধু চীনে নয়, লিন ওয়েনচুন ও রোনাল্ড লি হ্যারিকের মতো মানুষের সংখ্যা গোটা বিশ্বেই বৃদ্ধি পাওয়া দরকার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। 

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)

Link copied