তারা কি ফিরবে?
পঞ্চাশ বছর আগে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান নামের অমানবিক রাষ্ট্রের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল যে রাষ্ট্রটি তা আজ পরিণত বয়সে পদার্পণ করেছে। এবছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি।
বাঙালি জাতির ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বিভিন্ন বয়সের, শ্রেণি-পেশার ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মাহুতির বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এ স্বাধীনতা। বাংলাদেশ নামের স্বাধীন একটি আবাসভূমির জন্য; নতুন একটি পতাকা আর মানচিত্রের জন্য আমরা হারিয়েছি আমাদের স্বজন; প্রিয়জনদের। বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোররাও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। অংশ নিয়েছিল বিভিন্ন আন্দোলনে। মিছিলে মিছিলে শ্লোগানে শ্লোগানে তারাও প্রকম্পিত করে তুলেছিল বাংলার আকাশ-বাতাস। সীমাহীন সাহসিকতায় বুলেটের সামনে পেতে দিয়েছিল তাদের বুক। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল এদেশের রাজপথ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের এ লড়াই মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই। ১৯৫২ সালে লড়াই হয়েছে মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে। ১৯৬৯ সালে লড়াই হয়েছে স্বাধিকার অর্জনের জন্য; সর্বশেষ ১৯৭১ সালের লড়াই স্বাধীনতার জন্যে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রজনতার যে মিছিল বের করেছিল; সেই মিছিলের ওপর গুলি বর্ষণ করেছিল পুলিশ। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকেই লুটিয়ে পড়ে রাজপথে। পিচঢালা কালো পথ সেদিন যেন রক্তের বন্যায় হোলি খেলেছিল। ওদের রক্তের অমূল্য দামে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় বাংলাভাষাকে। এই ভাষা আন্দোলনেও রয়েছে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণ এবং তাদের আত্মত্যাগের গৌরবময় উপাখ্যান। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলির আঘাতে আহত হয়েছিল দশ-বারো বছরের এক কিশোর। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। কিন্তু নিষ্ঠুর বুলেটের আঘাত তাকে বাঁচতে দেয়নি। সে রাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল সেই কিশোরটি। তার পরনে রক্তাক্ত জামাটি বাঁশের আগায় ঝুলিয়ে পরদিন অর্থাৎ বাইশে ফেব্রুয়ারি মিছিল করেছিল সবাই। দুঃসাহসী সেই কিশোরের রক্তাক্ত জামাটি সেদিন পতাকা হয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ভাষা সৈনিকদের। কিন্তু সেই কিশোরের নাম পরিচয় আমরা আজও জানতে পারিনি; দিতে পারিনি তার যথাযোগ্য মর্যাদা। ভাষা আন্দোলনে প্রাণ উৎসর্গ করা আরেক কিশোরের নাম অহিউল্লাহ। হত্যার পর পুলিশ তার লাশ গুম করে ফেলেছিল বলে জানা যায়।
স্বাধিকার আন্দোলনের লড়াই হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। প্রতিদিনই মিছিল, মিটিং, শোভাযাত্রা বের হতে লাগল। ছাত্র-জনতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকেরা রুখে দাঁড়িয়েছিল। শোষণ, অন্যায় আর পরাধীনতার বিরুদ্ধে হাতে হাত আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৈরি করেছিল বাঁধার প্রাচীর। এই আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিল শিশু -কিশোররা। আইয়ুব খানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হলো এদেশের সাধারণ মানুষ। প্রথমে যা ছিল ছাত্র আন্দোলন পরবর্তীতে তা রূপ নেয় গণআন্দোলনে, ক্রমে তা হয়ে যায় গণ অভ্যুত্থান।
সারাদেশ জুড়ে মিছিল। মিছিলের বন্যা দেখে স্বৈরাচার শোষকের বুক কেঁপে উঠেছিল। দিশেহারা হয়ে মিছিলে গুলি চালায় তারা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। অন্যায়ভাবে আসাদের এ মৃত্যু নাড়া দেয় সারা দেশের মানুষকে। মিছিলে মিছিলে ছেয়ে যায় ঢাকা শহর। সন্ধ্যা বেলায় ঢাকার আকাশ রক্তিম হয়ে ওঠে মশাল মিছিলে। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল করল ছাত্রজনতা। আন্দোলন বন্ধ করার জন্য স্বৈরাচারী সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। সে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল করার সময় সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের সামনে প্রথম শহীদ হয় রুস্তম নামের এক কিশোর। মিছিলের পর মিছিল এসে জড়ো হতে লাগল পল্টনে। এগিয়ে চলছে উত্তাল মিছিল; সেই মিছিলের সামনে হাত উঁচিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে অকুতোভয় এক কিশোর। ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র মতিউর রহমান তার নাম। মতিউরদের মিছিলটি আব্দুল গনি রোড দিয়ে সচিবালয় অভিমুখে ধেয়ে আসছে, ঠিক তখনই গর্জে ওঠে শোষকের অস্ত্র। গুলিতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় কিশোর মতিউরের দেহ, রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকার রাজপথ আরও একটি কিশোরের রক্তে। আসাদ এবং মতিউরের মৃত্যুসংবাদ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিল স্বৈরাচারের গদিতে। মরিয়া হয়ে উঠল এদেশের মুক্তি পাগল মানুষেরা-মানি না মানি না, মানবো না মানবো না, ছড়িয়ে গেল সবখানে।
৬৯ এর অভ্যুত্থানে জীবন উৎসর্গকারী আরও কয়েকজন কিশোরের নামও উল্লেখযোগ্য; তারা হলেন, মাদারীপুরের ১০ বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আলাউদ্দিন, কুমিল্লার দশম শ্রেণির ছাত্র মজিবর রহমান ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র কামাল উদ্দিন এবং দাউদকান্দির মজহার আহমেদ।
এই আন্দোলনে আরও একটি শিশু শহীদ হয়েছিল। নাম না জানা সেই ১০/১২ বছর বয়সী শিশুটি তার জীর্ণশীর্ণ দেহ নিয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। পরনে ছিল ছেঁড়া একটি প্যান্ট, শতচ্ছিন্ন শার্টটিকে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে মিছিলের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে উঠিয়ে শ্লোগানে শ্লোগানে সে কাঁপিয়ে তুলছিল ঢাকার বাতাস। অসাধারণ সেই দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন বিশিষ্ট আলোকচিত্রি শিল্পী রশীদ তালুকদার। ছবি তোলার মিনিট খানেক পরেই পুলিশ সেখানে গুলি চালায় এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে দুঃসাহসী সেই শিশুটি। ওর নাম পরিচয় আমাদের জানা হয়নি ঠিকই কিন্তু প্রতিবাদী শিশু-কিশোরদের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছে সে আমাদের হৃদয়ে, চেতনায়, সংগ্রামে এবং গৌরবে ও অহংকারে।
১৯৭১ এ আমরা লড়াই করেছিলাম পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে। ওদের দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি গর্জে উঠেছিল। সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি শিশু-কিশোররাও অংশ নিয়েছিল এ মুক্তিসংগ্রামে। দুরন্ত ডানপিটে কিশোর ছেলেটি তার খেলা ফেলে ছুটে গিয়েছিল রণাঙ্গনে, খেলনা ফেলে হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। আন্দোলনে শক্তি জোগাতে, দেশকে শত্রুমুক্ত করতে জীবন বাজি রেখেছিল অনেক অকুতোভয় শিশু-কিশোর। তাদের সবার নাম হয়তো ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই হয়নি। অনেকের নাম ঠিকানাও অজানা রয়ে গেছে বাঙালি জাতির কাছে। কিন্তু এদেশের আকাশে বাতাসে, এদেশের মাটিতে, লালসবুজ পতাকায় মিশে আছে ওরা।
বাঙালি জাতির সকল আন্দোলন-সংগ্রাম, চূড়ান্ত বিজয়, মহান স্বাধীনতা অর্জন, পতাকা ও আমাদের মানচিত্রের সঙ্গে মিশে আছে হাজারো শিশু-কিশোরের টগবগে লাল রক্ত। আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য যে সব শিশু-কিশোররা তাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করে অতীত হয়ে গেছে আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই। ওরা আমাদের আলোকবর্তিকা, পথ চলার পাথেয়। তাদের সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর রক্তিম অভিবাদন জানাতে গিয়ে বলতে চাই—
‘তারা কি ফিরিবে এই সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে’
রেজিনা আক্তার ।। প্রধান গ্রন্থাগারিক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি