আইভীর হ্যাটট্রিক ও নৌকার জয়
গত পাঁচ বছরে নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। সেই তিনি, এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সর্বোত্তম বলেছেন। এ থেকেই নির্বাচন কেমন হয়েছে বোঝা যায়, যদিও সাবেক বিএনপি নেতা, পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম বেশকিছু সমালোচনা করেছেন।
নির্বাচনের আগেই বিভিন্ন মহল থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল যে, আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী এবারও তার ব্যক্তি ইমেজে বিজয়ী হবেন। ১৬ জানুয়ারি দিনশেষে ভোটের ফলাফলে সেই ধারণাই সত্যি হলো।
ব্যক্তিগত কারিশমায় তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হলেন আইভী। তবে তার জন্য কাজটি সহজ ছিল না এ কারণে যে, কোন্দল-কাঁটায় বিদ্ধ তার দল এবং স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানসহ পুরো ওসমান পরিবার ও তাদের অনুসারীদের সাথে তার দ্বন্দ্বের একটা আবহ বরাবর বজায় ছিল।
ভালো-মন্দের মিশেলে একজন ব্যক্তির ভাবমূর্তি নির্মিত হয়। নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরিবার কেন্দ্রিকতার ধারাবাহিকতায় সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রয়াত পিতা আলী আহাম্মদ চুনকা চিরদিনই ছিলেন এক উজ্জ্বল নাম এবং সেই ধারাবাহিকতায় নিজ দলের ভেতরতার শত্রু, বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বী সবাইকে মোকাবিলা করে বাবার মতোই ভালো সংগঠক হয়ে জনমানুষের নেত্রী হয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী।
নিজ দলের ভেতরকার শত্রু, বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বী সবাইকে মোকাবিলা করে বাবার মতোই ভালো সংগঠক হয়ে জনমানুষের নেত্রী হয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী।
তার সেই সাংগঠনিক মুনশিয়ানার জন্য ২০১১-তে দল তাকে মূল্যায়ন না করলেও বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। এখনকার এই বৈরী সময়ে, নিজ দলের দায়িত্ব, শক্তিশালী পক্ষের সব প্রকার বিরোধিতাকে পরাজিত করে তিনি হ্যাটট্রিক করেছেন। তার প্রতি নারায়ণগঞ্জের মানুষ, সমর্থক, অনুরাগীদের ভাবাবেগ স্পষ্ট বোঝা গেল আরও একবার।
রাজনীতির বিচিত্র ধারাপথে আইভী আজ এই বাণিজ্য নগরীর অবিসংবাদিত নেত্রী। সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, খুন খারাবির সাথে জড়িত গোষ্ঠীর সাথে সাহস করে লড়াই করে যাওয়ায় তার লড়াকু ভাবমূর্তিই তাকে দলীয় প্রতীক পেতে সাহায্য করেছে। নৌকার ভোট আছে, আবার সেখানে বিভাজন আছে। কিন্তু তার ভোটাররা তাকে বিভাজনের জায়গা থেকে বিচার করেনি।
এই জমানায় এমন ‘লড়াকু’ এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থী খুব কমই দেখা যায়। তাই সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি ফেসবুকে লেখেন, ‘শেখ হাসিনার দরকার ১৭৫ জন আইভী, জাতীয় নির্বাচনের আগে এই আইভী খোঁজার প্রক্রিয়া চলুক’। আইভীকে নৌকা জয় করতে হয়েছে এবং দল তাকেই যোগ্য বিবেচনা করায় বিজয় সহজ হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে আইভীর বিজয়ের সাথে সাথে আরও অনেকগুলো বিজয় এসেছে বলা যায়। প্রথমত, এই নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অনেকদিন পর ভোটের সংস্কৃতিতে ফিরিয়েছে। অর্থাৎ অনেকদিন পর নির্বাচনকে খুঁজে পাওয়া গেছে।
পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি ছিল শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর। আঠারো দিনের প্রচারণায় পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। কোনো সহিংসতা ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে মেরুদণ্ড সম্পন্ন নির্বাচন কমিশনের সাথে সাথে নির্বাচনী মাঠের মূল যে খেলোয়াড় – রাজনৈতিক ও প্রার্থী- তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেটাও প্রমাণিত হলো এই নির্বাচনে।
তৈমুর আলম বিএনপি থেকে পদচ্যুত হলেও জেলা বিএনপি জামায়াত তার সাথে ছিল। আইভীর সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে ছিল শাসক দল আওয়ামী লীগ। দুই প্রার্থী নিজেরা এক অন্যকে আক্রমণ করে কথা বলেননি, শিষ্টাচার বজায় রেখেছেন, বিষোদগার করেননি এবং তাদের দলও নিয়মতান্ত্রিক প্রচারণা চালিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে আইভীর বিজয়ের সাথে সাথে আরও অনেকগুলো বিজয় এসেছে বলা যায়। প্রথমত, এই নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অনেকদিন পর ভোটের সংস্কৃতিতে ফিরিয়েছে। অর্থাৎ অনেকদিন পর নির্বাচনকে খুঁজে পাওয়া গেছে।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন শাসক দল আওয়ামী লীগের জন্য এক বড় পরীক্ষা ছিল। ইউপি নির্বাচনের সময় শাসক দল সারাদেশে কোন্দল-কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছে। দু’বছর পর যে জাতীয় নির্বাচন হবে তার জন্য দলের অবস্থান জানার সবচেয়ে বড় উপায় ছিল স্থানীয় নির্বাচনে দলের সাংগঠনিক শক্তি কতটা মজবুত সেটা যাচাই করা। কিন্তু সেটা করা গেল না। বরং তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের চিত্রটাই বড় হয়ে উঠল। ধানের শীষ নেই, অথচ একের পর এক হেরেছেন নৌকার প্রার্থীরা। এতে করে দলের ত্যাগী ও সাধারণ কর্মীদের মনোবলে চিড় ধরেছে কি না সেই অঙ্কটাও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে করতে হবে এখন।
সেই বিবেচনায় নিজেদের ভেতর সঙ্কট থাকলেও নৌকার এই বিজয় মনোবল চাঙ্গা করবে দলের কর্মীদের। সরকার ও নির্বাচন কমিশন কৃতিত্ব দাবি করতে পারছে যে, তাদের দ্বারা ভালো নির্বাচন সম্ভব।
শামীম ওসমান তার জেলায় বলেছিলেন, কলাগাছও যদি নৌকা নিয়ে দাঁড়ায় তবে তার বিজয় নিশ্চিত। কিন্তু আইভী কখনোই কলাগাছ ছিলেন না, সেটা তার কাছে ২০১১-এর নির্বাচনের পরাজয়ের সময়ই নিশ্চয়ই বুঝেছেন শামীম।
নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতিক, সুধী সমাজের প্রতিনিধি ও পেশাজীবী নেতারা মনে করছেন, এই জয় বহুলাংশে আইভীর নিজের। দলকে ছাপিয়ে ব্যক্তি আইভী জয়ী হয়েছেন। তার ওপর ভর করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে নৌকা। তবে আমি মনে করি, যেটাই হোক না কেন এই বিজয় শাসক দলের মনোবল চাঙ্গা করতে বড় ভূমিকা রাখবে সামনের দিনগুলোতে।
অনেকের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও শহরের ভোটাররা আইভীকে ছেড়ে যায়নি। উপরন্তু নাগরিক সমাজের জনসমর্থন তার দিকেই অধিকতর ঝুঁকেছে বলা যায়। আইভী গতি আর উচ্ছলতার প্রতীক। ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত রাজনীতিক তিনি নন। জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করার শক্তি তার আছে। তার নিজস্ব প্রভাব ও জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগকেও শক্তি জোগাচ্ছে। নিজেকে, নিজের দলকে, দলের নীতি ও কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে আইভী দরকার সব জনপদে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি