নৌকা ডুবিয়ে পেলেন আ.লীগে ঠাঁই, রয়েছেন সাঈদীভক্তও!

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে স্থান পেয়েছেন নৌকা ডুবিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া বিদ্রোহী প্রার্থীসহ সাঈদী ভক্তরাও। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের দায়ী করছেন পদবঞ্চিত ত্যাগী নেতাকর্মীরা। একইসঙ্গে কমিটি গঠনে দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও উঠেছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই কমিটির অনুমোদন দিয়ে সই করেন।
বিদ্রোহী প্রার্থী এখন ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক
কমিটিতে ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন মোহাম্মদ আবদুর রহিম। তিনি চন্দনাইশ ইউনিয়নের বরকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।

সবশেষ ২০২২ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদাউসুল আলমের বিরুদ্ধে আনারস মার্কা নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন আবদুর রহিম। ওই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী পেয়েছিলে ১ হাজার ৯৩৭ ভোট এবং আনারস মার্কার প্রার্থী পেয়েছিলেন ৫ হাজার ৬০৬ ভোট।
আরও পড়ুন- সাঈদীকে নিয়ে ফেসবুকে কবিতা লিখে আ.লীগ নেতা বহিষ্কার
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, জেলা কমিটিতে পদ পাওয়া আবদুর রহিম অতীতে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে ছিলেন না। টাকার বিনিময়ে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতাকে ম্যানেজ করে তিনি পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। তার এক ভাই বিএনপি এবং আরেক ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
দলীয় সূত্র জানায়, স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করা নেতাদের প্রায় সবাইকে শাস্তির আওতায় এনেছে দলটি। অভিযুক্ত বিদ্রোহী প্রার্থীদের দলে ফেরানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এরই মধ্যে আবদুর রহিম জেলা ইউনিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে স্থান পাওয়ায় নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও চন্দনাইশ থানা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদাউসুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবদুর রহিম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। তিনি একসময় জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং বরকল ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। হুট করে ২০১৮ সালের পর থেকে তিনি আওয়ামী লীগ করা শুরু করেন। গত বছর তিনি নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচনও করেছেন। তাছাড়া তিনি একটি ফৌজদারি মামলায়ও সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ ধরনের ব্যক্তিকে আমাদের নেতারা জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে রেখেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নবগঠিত কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুর রহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নৌকার মনোনয়নের সময় আমার নাম ২ নম্বরে গিয়েছিল। কিন্তু নেত্রী কোনো কারণে তাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। নির্বাচনে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। আমি ১৯৯৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগ করি। দলের জন্য একাধিক মামলা খেয়েছি। পদের লোভ করিনি। শুধু কাজ করেছি। এখন দল আমাকে মূল্যায়ন করেছে। এরপর প্রতিপক্ষের লোকজন আমাকে নিয়ে অপপ্রচার করছেন।
এদিকে, গত ১৪ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যান। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাঈদীকে নিয়ে শোক প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বেশ কিছু নেতাকর্মী।
বিষয়টিকে খুব ভালোভাবে নেননি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও দলের অনেক নেতাকর্মী। ইতোমধ্যে শৃঙ্খলাজনিত কারণ দেখিয়ে অনেককে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের অনেককে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে স্থায়ী বহিষ্কারের আবেদনও করা হয়েছে।
সাঈদীকে নিয়ে পোস্ট দেওয়া সেলিম জেলা আওয়ামী লীগে!
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সদস্য হিসেবে স্থান পেয়েছেন মো. শহিদুল কবির সেলিম। গত ১৪ আগস্ট সাঈদীর মৃত্যুর পর শোক জানিয়ে ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। মুহূর্তেই এটি ছড়িয়ে পড়ে দলের মধ্যে গুঞ্জন তৈরি হয়। এখন তাকে নতুন করে জেলা কমিটির সদস্য করায় আবার বিষয়টি আলোচনায় আসে।

যদিও শহিদুল কবির ওইসময় তার আইডি হ্যাক হয়েছিলেন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, যেসময় স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছিল, তখন আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। বন্যার কারণে বাড়িতেও পানি ঢুকেছিল। এ কারণে মোবাইল বন্ধ ছিল। কেউ হয়ত আমার আইডি হ্যাক করে এই স্ট্যাটাস দিয়েছে। পরে আমি আইডি ফিরে পেয়ে স্ট্যাটাল ডিলিট করে দিয়েছি। এখন আমি কমিটিতে পদ পাওয়ায় ফের অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে।
ওবায়দুল কাদেরকে অবহিত করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে: দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির জন্য দলের বিপুল পরিমাণ ত্যাগী নেতাকর্মীরা চেষ্টা করেছেন। দীর্ঘদিন পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ায় তারা পদের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। দলের জন্য ত্যাগ ও পরিশ্রমের স্বীকৃতি পেতে মুখিয়ে ছিলেন অনেকেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা পর্যায়ের এক নেতা বলেন, দলের জন্য কত কাজ করেছি। বিনিময়ে কোনোদিন কিছু চাইনি। বর্তমানে দল টানা তিনবারের মতো ক্ষমতায়। অথচ সরকার থেকেও কিছু নিইনি। এবার দক্ষিণ জেলার নেতারা মূল্যায়ন করবে বলে আশায় ছিলাম। অন্তত আমি পদ না পেলেও আমাদের মতো ত্যাগীরা মূল্যায়ন পেলেও খারাপ লাগত না। এখন পদ পেয়েছেন বিদ্রোহী ও হাইব্রিড নেতারা। যারা দলের জন্য কিছু তো করেন নাই, উল্টো জামায়াতপ্রীতি রয়েছে।
আরও পড়ুন- সাঈদীকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট, সাতক্ষীরায় ৩ ছাত্রলীগ নেতা বহিষ্কার
এ বিষয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করা কয়েকজনকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অবহিত করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর সাঈদীর পোস্টদাতার বিষয়ে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি। এটার সত্যতা পেলে তাকে বাদ দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর নগরের জিমনেসিয়াম মাঠে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে সভাপতি এবং মফিজুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন।
এমজে