কৃষক খেতমজুর গণমঞ্চের আত্মপ্রকাশ

‘কৃষকদের অধিকার আদায়, সংকট নিরসন ও ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যমত গড়ে তোলার প্রত্যয়ে’ আত্মপ্রকাশ করেছে কৃষক খেতমজুর গণমঞ্চ।
বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে দলটি।
লিখিত বক্তব্যে মঞ্চের প্রধান সমন্বয়কারী দেওয়ান আব্দুর রশীদ বলেন, বাংলাদেশ তার ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটকালীন মুহূর্ত পার করছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দেশে প্রায় একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমান ফ্যাসিবাদী- কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে একদলীয় শাসনকে ক্রমশ শক্তিশালী করছে। আর একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে বর্তমান সরকার দেশের সমস্ত সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে।
বিরোধীমত দমনে হামলা-মামলা-খুন-গুমের জন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে। নাগরিকের ন্যায়বিচার ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব যে আদালতের, সে আদালত আজ বিরোধীমত দমনের প্রধানতম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল-মতের মানুষের উপর লক্ষ লক্ষ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের সার্বিক এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের অবস্থা হয়েছে সবচেয়ে ভয়াবহ। বর্তমান সরকারের আমলে কৃষকরা রাষ্ট্রীয় ও ব্যবস্থাগত শোষণের শিকার। এমনকি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পানি না পেয়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। দফায় দফায় সারসহ কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বাজারে সিন্ডিকেটের দখলদারিত্বের ফলে কৃষক হয়েছেন দিশেহারা। নানান শিল্পকারখানা, আবাসন প্রকল্পের ভূমিদস্যুতায় কৃষক তার শেষ অবলম্বন ভূমিটুকুও হারিয়ে পরিণত হয়েছেন ভূমিহীন খেতমজুরে। যারা শহরে পাড়ি জমাতে পারেননি তারা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে হয়েছেন অটোভ্যান কিংবা অটোরিকশা চালক। করোনা, হাওড় অঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের প্লাবনভূমিতে বন্যায় ফসল ভেসে গেলেও রাষ্ট্র কৃষকের পাশে দাঁড়ায়নি।
কৃষিপণ্যের বাজারের ওপর তো কৃষকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার এখন সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দিয়ে রেখেছে সরকার। ফলে কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য তো পাচ্ছেনই না, এমনকি নূন্যতম উৎপাদন খরচটুকুও বাজার থেকে তুলে আনা সম্ভব হচ্ছেনা। এর ফলে কৃষি পরিণত হয়েছে একটি অলাভজনক পেশায়।
এমনকি সরকার একযোগে ৩৬টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়ায় কৃষক হারিয়েছে তার প্রধান অর্থকরী ফসল থেকে লাভবান হবার সুযোগ। ধাপে ধাপে বন্ধ কিংবা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে আছে দেশের অধিকাংশ চিনিকল।
আধুনিকীকরণের অভাব, সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির কারণে চিনিকলগুলো লাভজনক না হয়ে হয়েছে ক্ষতির বোঝা। ফলে অপূরণীয় অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন এদেশের আখচাষীরা। একইসঙ্গে কৃষিতে কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসন, ক্ষুদ্রঋণের চাপ এবং মধ্যসত্ত্বভোগীদের সিন্ডিকেটের ফলে এদেশের কৃষি ও কৃষক অন্যান্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বড় সংকটের মুখোমুখি।
তিনি আরও বলেন, খেতমজুরদের এখনও সারা বছর কাজের ব্যবস্থা নেই। সরকারের কর্মসৃজন প্রকল্পসমূহের বিশেষ কোনো কার্যকারিতা নেই। ভূমিহীনরা এখনও খাসজমির অধিকার থেকে বঞ্চিত। গ্রামের গরীবদের জন্য নেওয়া প্রকল্পসমূহে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি আর দলবাজি। আর গ্রামীণ মজুরদের এখনো শ্রমিক হিসাবে কোনো স্বীকৃতি নেই। গ্রামের গরীবদের জন্য রেশনেরও কোনো ব্যবস্থা নেই।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে চলমান যুগপৎ আন্দোলনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ৩১ দফার ভিত্তিতে একটি গণআন্দোলন গড়ে তোলার কাজ করছেন। এই ৩১ দফার মধ্যে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এক নতুন রাজনৈতিক সামাজিক চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং আমরা মনে করি এই মুহূর্তে ৩১ দফা বৃহত্তর জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে। চলমান ফ্যাসিবাদ কর্তৃত্ববাদ বিরোধী ৩১ দফার এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে কৃষক-খেতমজুর-ভূমিহীনদের অংশগ্রহণ জরুরি। এখনও দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে থাকেন এবং নানান মাত্রায় কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাদের বাদ দিয়ে এই আন্দোলনকে চূড়ান্তরূপ প্রদান করা সম্ভব নয়। ফলে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং কৃষির অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবেলায় এবং ফ্যাসিবাদী- কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে এই দেশের কৃষক খেতমজুরের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশ খেতমজুর গণমঞ্চের ৯ দফা দাবি
১. ফসলের লাভজনক দাম দিতে হবে। কৃষি উপকরণের দাম কমাতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে অন্তঃকেন্দ্র বসিয়ে প্রকৃত চাষীর কাছ থেকে উপযুক্ত মূল্যে ফসল কিনতে হবে।
২. কৃষিবান্ধব কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জাতীয় নিম্নতম মজুরি ও জীবনযাত্রা বিবেচনায় নিয়ে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
৩. কৃষকদের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দুর্নীতিমুক্ত ও দলীয়করণমুক্ত কৃষিকার্ড দিতে হবে। জামানতবিহীন ও সুদমুক্ত কৃষিঋণ দিতে হবে। উন্নয়ন ও নগরায়নের নামে যথেচ্ছভাবে আবাদি কৃষি জমি নষ্ট করা যাবে না।
৪. কৃষিঋণ নিয়ে ব্যাংক ও এনজিওদের জালিয়াতি-বীমাদাবি-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণের জন্য সার্টিফিকেট মামলা, চেকের মামলা, গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে।
৫. পাটের দাম মনপ্রতি ৬০০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে। বন্ধ করা পাটকল ও চিনিকল আধুনিকায়নের মাধ্যমে সরকারিভাবে চালু করাতে হবে। আখচাষী ইউনিয়নের ১৯ দফা বাস্তবায়ন করতে হবে।
৬. জাতীয় কমিশন গঠন করে আমুল ভূমিসংস্কার করতে হবে। দখলকৃত খাসজমি উদ্ধার করতে হবে। সমবায়ের ভিত্তিতে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।
৭. নদী-হাওড়-বিল-খালের ইজারাপদ্ধতি বাতিল করতে হবে। প্রকৃত মৎসজীবী ও ভূমিহীনদের মধ্যে সমবায়ের ভিত্তিতে খাসজমি বন্দোবস্ত দিতে হবে।
৮. খেতমজুর ও গ্রামীণ মজুরদের সারাবছর কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জন্য ১৫০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্প চালু করাতে হবে। গ্রামের গরীবদের জন্য নেওয়া প্রকল্পসমূহে দলীয়করণ, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এসব প্রকল্পে গণতদারকি ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গরীবদের জন্য গ্রামীণ রেশনিং ব্যবস্থা ও বয়স্কদের জন্য পেনশন চালু করতে হবে।
৯. কতৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিদায় করে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জবাবদিহিতামূলক, শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
মঞ্চের প্রধান সমন্বয়কারী দেওয়ান আব্দুর রশীদ নীলুর সভাপতিত্বে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী কৃষক সংহতির আনসার আলী দুলাল,ভাসানী কৃষক পরিষদের সভাপতি খোরশেদ আলম প্রমুখ।
ওএফএ/এমএসএ