আর কত বছর পর কাউন্সিল করবে বিএনপি?
প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো সময়মতো কাউন্সিল করতে পারেনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলীয় গঠনতন্ত্রে তিন বছর পর পর সম্মেলন করার কথা বলা হয়েছে। সেটি করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। সর্বশেষ ২০১৬ সালে বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল হওয়ার পর ৮ বছর পেরিয়ে গেছে। খুব সহসা আর কোনো কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না বিএনপি নেতারা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে টানা আন্দোলনে থেকেও সরকারকে দাবি মেনে নিতে বাধ্য করতে না পারায় বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তৃণমূলে প্রশ্ন আসছে— ব্যর্থ নেতৃত্ব দিয়েই কি আগামীতে বিএনপি চলবে নাকি কাউন্সিল করে কিংবা শূন্য পদে নতুন নেতৃত্ব এনে দল পুনর্গঠন করা হবে?
বিএনপি নেতারা বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির পক্ষে কাউন্সিল করা সম্ভব নয়। আগামীতে কবে বিএনপির সম্মেলন হবে তাও এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। কারণ, কাউন্সিলের বিষয়টি সামনে এলেই চলে আসে শর্তসাপেক্ষে মুক্ত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আগামীতে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা না থাকার বিষয়টি। তিনি না থাকলে সেক্ষেত্রে তারেক রহমান বিদেশে থেকেই পূর্ণাঙ্গ চেয়ারম্যান হবেন নাকি দেশে থাকা কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু তারেক রহমান বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে জিয়া পরিবারের বাইরে কাউকে দায়িত্ব দিতে চান না।
এ অবস্থায় আপাতত বিএনপিতে সম্মেলন করার চিন্তা নেই। তবে শূন্য পদে নতুন নেতৃত্ব এনে দলকে পুনর্গঠন করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। সেটাও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে সম্ভব নয় বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
বিএনপির বিগত কাউন্সিলগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে— ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক পথ-মতের অনুসারীদের এক প্লাটফর্মে এনে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা বটমূলের খোলা চত্বরে প্রথম সম্মেলনে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী হন প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব। দলটির দ্বিতীয় কাউন্সিল হয় চার বছর পর ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর)। সেই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব হন যথাক্রমে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
সাত বছর পর ১৯৮৯ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির তৃতীয় কাউন্সিল। ওই কাউন্সিলে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন এবং সালাম তালুকদার মহাসচিব হন। চার বছর বিরতি দিয়ে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে চতুর্থ কাউন্সিলে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন এবং আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া মহাসচিব হন। এর দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম কাউন্সিলে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন এবং অ্যাডভোকেট খন্দকার দেলওয়ার হোসেন মহাসচিব নির্বাচিত হন।
আরও পড়ুন
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলটির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বারের মতো খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন এবং ভারপ্রাপ্ত থেকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিন বছর মেয়াদি এই কমিটির বয়স ইতোমধ্যে ৮ বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান। তার নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি ৭টি আসন লাভ করে। আর সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাছান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাউন্সিল বা পুনর্গঠন নিয়ে এখনো দলে কোনো আলোচনা হয়নি। শূন্য পদ পূরণ করার চাইতে আমরা এখন অন্যান্য কার্যক্রমকে গতিশীল করা নিয়ে কাজ করছি।
শূন্য পদে আলোচনায় যারা
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর ঘোষিত কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে স্থায়ী কমিটির দুটি পদ ফাঁকা ছিল। বিগত বছরগুলোতে ১৭ সদস্যের মধ্যে তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার ও মওদুদ আহমেদ মারা যান। আর দল থেকে পদত্যাগ করেন (অব.) মাহবুবুর রহমান। এছাড়া দীর্ঘ ৫ বছর ধরে অসুস্থ আছেন রফিকুল ইসলাম মিয়া। এর মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান থেকে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। বর্তমানে ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে ১২ জন সদস্য রয়েছেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান পদাধিকার বলে স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ায় বাকি পাঁচটি পদ খালি রয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির শূন্য পাঁচটি পদে আলোচনায় রয়েছেন— বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ডা. জাহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, শামসুজ্জামান দুদু ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এছাড়া সংস্কারপন্থি হলেও বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ আলোচনা রয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘কাউন্সিল তো করতেই হবে। সময়-সুযোগ করে আমরা করব। তবে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কাউন্সিলের তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।’
নাম না প্রকাশ করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং দলের নেতাকর্মীদের জন্য সান্ত্বনা সুলভ কাউন্সিল ও পুনর্গঠনের বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। কাউন্সিল সম্ভব না হলেও দল ও অঙ্গসংগঠনগুলোকে পুনর্গঠন করতে হবে।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, তারেক রহমানকে চিন্তা করতে হবে কীভাবে দল পরিচালনা করবে? তিনি কি বিদেশে বসে আদেশ দিয়ে দল পরিচালনা করবেন, না কি দেশের বাস্তবতা বুঝে এখানে কাউকে দায়িত্ব দেবেন দল পরিচালনায়। তবে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বাস্তবতা বুঝলে দায়িত্ব নিজের কাঁধে না নিয়ে এখানে কাউকে দায়িত্ব দেবেন বলে আশা করি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, এখন দলের মূল টার্গেট অঙ্গ-সংগঠনগুলো শক্তিশালী করা। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তারপর নতুন করে আন্দোলনে নামতে হবে।
টুকু বলেন, আমরা আন্দোলনে ব্যর্থ নয়, সফল। মানুষ আমাদের কথা শুনেছে। ভোট দিতে যায়নি। সরকার নিজেরা-নিজেরা ভোট করেছে। সেখানেও মারিং-কাটিং করতে হয়েছে। এটাই তো দেশের মানুষের সফলতা।
এএইচআর/এমজে