নতুন বছরে মাঠে থাকতে চায় বিএনপি

অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সাংগঠনিক দূর্বলতায় দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই নিষ্প্রভ বিএনপি। বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে সুবিধা করতে পারছে না দলটি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি পর্যন্ত হয়েছে সরকারের সহানুভূতিতে। এমন পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও অনৈক্য দূরে রেখে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চায় বিএনপি। পাশাপাশি বৃহত্তর জোট গঠন করে ‘গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার আন্দোলন’ এ নামার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্ব পাবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি। তাই বছরজুড়ে নানা কর্মসূচি পালন করে রাজনীতিতে দৃশ্যমান থাকার পরিকল্পনা রয়েছে দলের।
যদিও অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও অনৈক্য দূর করে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন নেতারা।
২০২১ সালে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করতে তাদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা হবে। ২০২১ সাল হবে কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার বছর।
শামসুজ্জামান দুদু, ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের প্রস্তুতি
বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি, ৮টি সাংগঠনিক বিভাগীয় কমিটি এবং ২৫টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সবগুলো কমিটি নিজেদের করণীয় নির্ধারণে একাধিক বৈঠক করেছে। বিষয়ভিত্তিক কমিটিগুলো সুবর্ণজয়ন্তী পালনে তাদের প্রস্তাবনাগুলো লিখিত আকারে জাতীয় কমিটির কাছে জমা দিয়েছে। এখন সেগুলো সমন্বয় করে বছরব্যাপী কর্মসূচির একটি রোড়ম্যাপ চূড়ান্তে কাজ শুরু করেছে জাতীয় কমিটি।
সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এবং আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন করতে চাই। সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস; বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের প্রকৃত ইতিহাস নানা কর্মসূচির মাধ্যমে তুলে ধরবো। দেশের মানুষকে এবং বর্তমান প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস জানাতে আমাদের পরিকল্পনা চলছে।
তিনি আরও বলেন, সুর্বণজয়ন্তীর বিভিন্ন উপ-কমিটি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। জাতীয় কমিটির কাছে তাদের দেওয়া প্রস্তাবনাগুলো সমন্বয় করে একটা চূড়ান্ত কর্মসূচির তালিকা প্রস্তুত করা হবে। আগামী ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা নিয়ে আমরা আগাচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা, মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা-বই সংগ্রহ এবং প্রদর্শনীসহ নানা কর্মসূচি থাকবে।
দলে কর্তৃত্ব নিয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের ওপর ‘কিছুটা’ প্রভাব বিস্তার করতে চান সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ফখরুল-রিজভীর দ্বন্দ্বে মনে হয় ভারপ্রাপ্ত তারেক রহমানের আশকারা আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি নেতা
অভ্যন্তরীণ কোন্দল দূর করার লক্ষ্য
বিএনপির নেতারা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিদায়ী বছর বিএনপির সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ বন্ধ ছিল। যার ফলে সাংগঠনিক দুর্বলতা ও দলের অভ্যন্তরীণ অনৈক্য-বিভেদ বহাল রয়ে গেছে। তাই চলতি বছর সুবর্ণজয়ন্তীর কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি সমানতালে চলবে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ।
তারা জানান, দলের স্থায়ী কমিটি থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনৈক্য-বিভেদ দূর করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য দলকে প্রস্তুতের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। কেননা সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে হাজার কর্মসূচি দিয়ে মাঠের রাজনীতিতে সফল হওয়া যায় না। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ গত কয়েক বছরে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির আন্দোলন সফল না হওয়া।
দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা কমিটি গঠন নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতার মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। এর বাইরে দলে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতার মধ্যে অনৈক্য তৈরি হয়েছে। সবমিলিয়ে তৃণমূলের পাশাপাশি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতেও বিভেদ-অনৈক্য দেখা দিয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পরিকল্পনা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সারাবছর বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করা। আর দল হিসেবে বিএনপিকে গোছানোর যেসব কার্যক্রম বাকি আছে সেগুলো সম্পন্ন করা। ২০২১ সালে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করতে তাদেরকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা। ২০২১ সাল হবে কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার বছর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, কিছু বিষয় আছে, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। কিছু বিষয় আছে, স্বাভাবিক জিনিসগুলো মানা, না মানা। কিছু বিষয় আছে, সংগঠনের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখা। এগুলো কোনোটাই সংগঠনকে গতিশীল করে না, বরং অকার্যকর করে। বিএনপিতে এখন সেটাই চলছে।
এই নেতা জানান, কুমিল্লা জেলা কমিটি নিয়ে এক ধরনের মনোমালিন্য চলছে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের মধ্যে। এছাড়া দলে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে মাঝে মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের ওপর ‘কিছুটা’ প্রভাব বিস্তার করতে চান সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আর মির্জা ফখরুল-রিজভীর বিষয়টাতে মনে হয় ভারপ্রাপ্ত তারেক রহমানের আশকারাও আছে।
বৃহত্তর জোট গঠনের পরিকল্পনা
বিএনপির একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলছেন, নব্বই দশকে তিন জোটের যুগপৎ আন্দোলনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। বর্তমান ‘প্রশাসন নির্ভর’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে হলে সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সেরকম একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সে লক্ষ্যে বিএনপি স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীর কর্মসূচিগুলোতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত করে সব দলের সঙ্গে ন্যূনতম বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি করতে চায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির প্রভাবশালী এক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গঠনে বারবার একটি বাধা সামনে চলে আসে। সেটা হলো স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে নিয়ে কেউ বৃহত্তর ঐক্য গঠন করতে চায় না। এবার জামায়াত ছাড়া সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি জোট গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। আর সেটা না হলে জামায়াতকে নিয়েই রাজপথের কর্মসূচি বা আন্দোলন ভিত্তিক ন্যৃনতম বোঝাপড়ার মাধ্যমে জোট করতে চাই আমরা। প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে সুবর্ণজয়ন্তীর কর্মসূচিগুলোতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য দলগুলোকে যতবেশি পারা যায় যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ বলেন, সুবর্ণজয়ন্তীর কর্মসূচিগুলোতে সব দলকে আমন্ত্রণের পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ আমরা এটাকে সার্বজনীন করতে চাই।
দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, নতুন বছরে আমাদের জোটের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সেটা রাজপথের কর্মসূচিভিত্তিকও হতে পারে। আবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতো কোনও জোটও হতে পারে।
এএইচআর/এসআরএস