বাংলাকে অবজ্ঞা করে দেশের প্রতি ভালোবাসা হারাতে বসেছি

বহুবার বিদেশ ভ্রমণ হয়েছে তবে ভাষার তাৎপর্য তখন বুঝতে পারিনি। যখনই স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করলাম তখনই বুঝতে পারলাম মাতৃভাষা কী। পর্তুগালে বসবাসকালে যেখানে সেবা গ্রহণ করতে গিয়েছি প্রথমেই সম্মুখীন হয়েছি পর্তুগিজ ভাষা না জানার প্রতিবন্ধকতার। তবে শুরুতে কিছুটা গ্রহণ করলেও দিন যত বাড়ছিল দেখলাম কোনোভাবেই আর যেন পর্তুগিজ ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা স্থানীয়রা সঠিকভাবে নিতে পারছে না।
একটু খেয়াল করে দেখলাম এদের অনেকেই ইংরেজি জানে। একেবারে নিরুপায় হলে তখন তারা ইংরেজিতে কথা বলে যোগাযোগ করে। তবে প্রথমেই চেষ্টা করে সেবা গ্রহণকারীর মুখ দিয়ে স্থানীয় ভাষা বের করার। তারা একটা প্রশ্ন করে সব সময়, এতদিন আছেন ভাষা কেন শিখছেন না। এখানে থাকতে হলে ভাষা জানতে হবে। এরা আমাদের চেয়ে ভালো ইংরেজি জানে। তারপরও তাদের মাতৃভাষাকে আমার মাঝে দিয়ে দিচ্ছে।
এক সময় মনে হলো, আমাদের দেশে যেহেতু ডাক্তাররা ইংরেজি ভাষায় ডিগ্রি অর্জন করেন এখানেও হয়তো সেই রকম হতে পারে। ডাক্তাররা হয়তো খুব ভালো ইংরেজি বুঝবেন কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। এখানকার সব লেখাপড়া স্থানীয় পর্তুগিজ ভাষায়। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন কিন্তু আমাদের মত গাদা গাদা ইংরেজি বই নয়, তারা তাদের মাতৃভাষায় সব বই পড়ে উচ্চ ডিগ্রিধারী হয়। আমাদের তো কোনো রকম উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হলেই ইংরেজি ছাড়া উচ্চশিক্ষা নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না।
আমাদের দেশে অফিস-আদালতে ইংরেজি ছাড়া চলেই না, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেকোনো মিটিং কনফারেন্স যাই বলুন না কেন, ইংরেজি ভাষার ছড়াছড়ি। অথচ পর্তুগাল ও ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশে তাদের মাতৃভাষায় অফিস কার্যক্রম পরিচালিত হয়, হোক সেটা সরকারি বা বেসরকারি। অফিসের জন্য কর্পোরেট প্রেজেন্টেশনে ইংরেজি বাধ্যতামূলক আমাদের জন্য কিন্তু এদের বেলায় মাতৃভাষা। থানা পর্যায়ে সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগের পুরো ইন্টারভিউ চলে ইংরেজিতে, আমাদের দেশে ইংরেজি জানাটা একটা যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। অথচ এ মানুষগুলো কাজ করবেন দেশের অভ্যন্তরে ও তাদের গ্রাহক বাংলায় বলবেন, ইংরেজিতে নয়।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের কথা তো বলাই বাহুল্য। যদিও এখানের তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে গল্প করলে দেখা যায়, তারা একটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেননি অনেক ঘণ্টার আলাপচারিতায়। অথচ আমাদের তরুণ প্রজন্ম মনে করে, কিছু ইংরেজি বলতে পারলেই হয়তো তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাবে। আমাদের কথায় ইংরেজি মিশে জগাখিচুড়ি। এর জন্য এ তরুণ প্রজন্ম দায়ী নয়, এর জন্য দায়ী স্বাধীনতা লাভের পর ক্ষমতায় থেকে বাংলাকে মাতৃভাষার শতভাগ রূপদান না করা।
ভাষা হচ্ছে প্রতিটি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য জানার প্রথম চাবিকাঠি অর্থাৎ আপনি যদি ভাষা না জানেন তাহলে কোনোভাবেই ইতিহাস-ঐতিহ্যকে জানতে পারবেন না। আমরা যদিও বাংলা ভাষা জানি, কিন্তু বাংলাকে অবজ্ঞা করে বিদেশি ভাষার চর্চা আমাদের বিদেশি ঐতিহ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ধাবিত হচ্ছি বিদেশি ভাষার দিকে, সে ক্ষেত্রে বাঙালিয়ানা তো হারাবেই। ভুলতে বসেছি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, হারাতে বসেছে শিকড়ের টান। এভাবেই ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে দেশপ্রেম।
একুশে ফেব্রুয়ারি আসলেই পর্তুগালে স্থানীয় লোকজন ও সহকর্মীদের সঙ্গে খুব গর্ব করেই বলতাম একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অহংকার। কেননা আমরা বাংলাদেশিরাই একমাত্র জাতি, যারা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছি মায়ের ভাষাকে সমুন্নত রাখতে। কিন্তু যখনই শুধু মনের ভাবের বাস্তবায়ন এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও মানুষের মাঝে খুঁজে পেলাম, তখন নিজেকে কেমন যেন মনে হলো। একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা শুধু অন্তরে বয়ে বেড়াচ্ছি এর সঠিক বাস্তবায়ন আমরা করতে পারিনি। পারিনি সেই রক্তের ঋণ শোধ করতে, যারা অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। পারিনি তাদের উদ্দেশ্যকে সফল করতে। আমরা পারিনি সকল স্তরে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে।
লেখক : সমাজকর্মী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
এসএসএইচ