অপার সৌন্দর্যের অরোরা : কানাডায় প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ প্রদর্শনী

সূর্যের নিকটবর্তী চার্জযুক্ত সীমাহীন কণা পৃথিবীর বাইরের বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে অরোরা বোরিয়ালিস (নর্দার্ন লাইটস্) উজ্জীবিত হয়ে ওঠে ও নানা রঙের আলোতে উদ্ভাসিত হয়। বিশেষ করে ম্যাগনেটিক এ কণারাশি মেরু অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয় এবং আর্কটিক অঞ্চলের আকাশের মাঝে এক ওভাল তৈরি করে। বায়ুমণ্ডলের কোন স্তর উত্তেজিত হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে অরোরার রং পরিবর্তিত হয়। এটি সাধারণ রঙের একটি তীব্র গাঢ় সবুজ আভা, যা পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার উপরে অক্সিজেন পরমাণুর উত্তেজনার কারণে ঘটে। আবার নাইট্রোজেন পরমাণু স্তরে মিশে বেগুনি, নীল বা গোলাপী রঙের সৃষ্ট হয়।
নর্থওয়েস্ট টেরিটরির অঞ্চলগুলো সরাসরি অরোরা ওভালের নিচে অবস্থিত। পৃথিবীর যেকোনও জায়গার চেয়ে এ এলাকাটিতে তীব্র উত্তরীয় আলোর প্রভাব লক্ষণীয়। কম আর্দ্রতার সঙ্গে এখানকার আকাশ বেশ প্রশস্ত, খোলা এবং পরিচ্ছন্ন হওয়ার ফলে অরোরার আবির্ভাব বিভিন্ন ঋতুতে যে কাউকে অবাক করবে।
এখানে অরোরার সংস্কৃতি এতটাই আলোচিত যে এর ওপর হাজারো গল্প, কবিতা, গান ও কৌতূহলোদ্দীপক অবাস্তব কাহিনীও প্রচলিত আছে। যেমন আপনি যাই করুন না কেন, অরোরার নিচে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাবেন না বা শিষ দেবেন না।
যখন গেরি কিসউন শিশু ছিলেন, ম্যাকেঞ্জি নদীর পাড়ে বেড়ে উঠছিলেন, তখন গেরি কিসউনের বাবা-মা তাকে সতর্ক করেছিলেন যে, মাথার উপরে ঘূর্ণায়মান আলোর সঙ্গে খেলবে না, তাদের উদ্দেশ্য করে বাঁশি বাজাবে না। অন্যথায় আলো নিভে যাবে, মাথা কেটে নেবে এবং মাথা দিয়ে ফুটবল খেলবে।
এই গেরি কিসউন তুন্দ্রা নর্থ ট্যুরসের একজন গাইড এবং ইনুভিয়ালুইট বংশোদ্ভূত নাগরিক। প্রবীণ কিসউন বলেন, আমার শৈশব ও কিশোর বয়সে মনে আছে, অরোরা শুধু চারপাশে উপরে উঠানামা করতো তখন আমরা শিষ দিতাম আর এটি যেন নিচে নামতে শুরু করত। তখন আমরা ভয়ে বাড়ি ছুটে পালাতাম।
উপরে তাদের রঙের অনন্য জগৎ যেন জাদুকরী কোনও ফিতার মতো ঘূর্ণায়মান। অন্ধকার আকাশজুড়ে বেগুনি, সবুজ এবং লাল রঙের একটি ছাউনির মত এ আলওর দেখা মিলতো। দৈত্যাকার এ বিশাল অরোরার দিকে তাকালে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। এ অপূর্ব জগৎ সবার মনে গল্প, কবিতা বা গান লেখার এক মায়াবী পরিবেশের তৈরি করে। আদিবাসীরা হাজার হাজার বছর ধরে এ মহাজাগতিক জলসায় মন্ত্রমুগ্ধ।
নর্থওয়েস্ট টেরিটরিতে আদিবাসীরা অরোরাকে স্রষ্টার নির্মিত আগুনের স্থাপনা মনে করতো। বিশ্বাস করা হত, এর মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা আমাদের উপর নজর রাখতেন। আবার আরেকটি জাতি মনে করে, অরোরা হল মৃতদের আত্মা যারা আকাশে থাকে, পৃথিবীতে তাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কেউ কেউ মনে করেন, এখানে আলো বিলানো অরোরা যে তার প্রিয় কোনো সঙ্গীকে হারিয়ে এখন অতি উজ্জ্বল আলোয় রূপ নিয়েছেন।
অন্যদিকে, নর্দান এবং নর্থ স্টার অ্যাডভেঞ্চারের অপারেটর জো বেইলি বলেছেন, এরা পৃথিবীতে একটি বার্তা পাঠাচ্ছে, আপনি যদি বুঝতে পারেন। তারা বলছে- আমি (মৃত আত্মা) এখন এখানে ঠিক আছি, আমাকে নিয়ে কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই। আপনি আপনার জীবন উপভোগ করুন, ভালো কাজ করুন। আশা করি একদিন আমরা আবার একে অপরকে দেখতে পাবো।

জো বেইলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা একজন পর্যটকের সঙ্গে অরোরার নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন। সেই পর্যটক কাঁদতে শুরু করেছিলেন তার সেরা বন্ধুকে হারানোর জন্য। তার ওই বন্ধুটি স্তন ক্যান্সারে মারা গেছেন। বেইলির সঙ্গে তার ভ্রমণে আসার কথা ছিল।
তবে বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে, অরোরা বোরিয়ালিস হল ইলেকট্রনিকভাবে চার্জযুক্ত কণা যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আঘাত করার সময় রঙিন হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞায় পার্থিব মহিমার অভাব রয়েছে। সূর্যের কেন্দ্র থেকে সৌরঝড়ে জন্ম নেওয়া অরোরা ঘণ্টায় তিন মিলিয়ন কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর দিকে বিস্ফোরিত হয়। তারা আকাশ জুড়ে নানা রঙের এমন এক আলোকচ্ছটার সৃষ্টি করবে যাতে আপনি পার্থিব জগতের বাইরের কিছুকে অনুভব করতে পারবেন।
এই অরোরার ঝড় যখন তীব্র হয়, তখন এর শক্তি ৫০ হাজার ভোল্টে গিয়ে ঠেকে। যার অ্যাম্পিয়ার ২০ মিলিয়ন। সাধারণত আমাদের বসতবাড়ির সার্কিট ব্রেকারগুলো ১২০ ভোল্টে ৩০ অ্যাম্পিয়ারের বেশি হয় না।
সৌরবায়ুর এ বিস্ফোরণগুলো বছরে প্রায় ১,৫০০ বার পৃথিবীর বায়ু মণ্ডলে আঘাত হানে আর গড়ে প্রতিদিন কয়েকবার। এর বিস্ফোরণ যত বড়, অরোরা তত বেশি প্রাণবন্ত।
নর্থওয়েস্ট টেরিটরিতে ৩৬৫ দিনের মধ্যে অরোরার দেখা মেলে ২৪০টির মতো রাতে। এটি গ্রীষ্মের শেষের দিকে, শরৎ, শীত এবং বসন্তের শুরুর প্রায় প্রতিটি রাতেই দেখা যায়। আর এ নর্দান লাইটগুলো দেখতে সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকদের ভিড় জমে।
গেরি কিসউন এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতির কথা মনে রেখেছেন যারা কয়েক বছর আগে অরোরার চারপাশে ভ্রমণ করেছিলেন। মাইনাস-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আবহাওয়া সত্ত্বেও, তারা লাইটশো দেখতে এসেছিলেন। অরোরার নৃত্য দেখতে এ দম্পতি আধঘণ্টা বরফের ওপর শুয়েও ছিলেন।
কিশোর বয়সে কিসউন তার কুকুরের দল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় প্রায়শই আলো দেখতে পারতেন। আজও, যখন তিনি তাকান, আধ্যাত্মিক কিছু অনুভব করেন তিনি। তিনি মনে করেন অরোরা জাদু দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে হলে তা দেখার জন্য সেরা ঋতুতে আসতে হবে।
পিএইচ