শেষ আস্থার জায়গা এখনও প্রশাসন

আমি বসবাস করি সময়ের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা লোহিত সাগর তীরে অবস্থিত জেদ্দা শহরে। এটি মক্কা প্রদেশের সর্ববৃহৎ ও সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। লোহিত সাগরের উপর অবস্থিত সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর এই শহরেই অবস্থিত। ৪৩ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে শহরটি সৌদি আরবের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই শহরে ২০১২ সালের শেষের দিকে এসেছি রিয়াদ থেকে। দীর্ঘ এই সময়েও আমি এখানে টিকে আছি, সুস্থ আছি। এর মাঝে কতজনকে যে বিমানবন্দরে বিদায় দিয়েছি, যাদের অনেকে দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে শেষ বয়সে নিজ দেশে ফিরে গেছেন। অনেক প্রবাসী এখানে স্বপ্ন পূরণ করতে এসে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই মৃত্যু বরণ করেছেন।
এখন পৃথিবীর সব দেশই নানাভাবে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার সার্বিক প্রচেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু সৌদি জনস্বাস্থ্য বিভাগের কাজ করার পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেখানে আমরা চতুর্দিক থেকে শুনছি লকডাউন এবং সম্পূর্ণ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, সেখানে সৌদি সরকার ও জনস্বাস্থ্য বিভাগ বারবার হাত ধোয়া ও পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার নির্দেশনা দিয়েছে। লকডাউনের মতো কঠোরতায় না গিয়ে শপিংমল ও দোকানপাট খোলা রেখেই স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মানার ক্ষেত্রে বেশি জোর দিয়েছে। যেকোনো সরকারি নীতির মতো এই নীতি বা নির্দেশিকা সবাই সমর্থন ও অনুসরণ করছে।

শুক্রবার (৭ মে) সৌদি মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, সরকারি-বেসরকারি সব সেক্টরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে যোগদানের পূর্বশর্ত হলো করোনা প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ। ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ‘টিকা নিন। নিরাপদ থাকুন।’
আমিও টিকা নিয়েছি, কারণ আমাকে সুস্থ থাকতে হবে। এই শহরে প্রতিদিন আমাকে কাজে বের হতে হয়। নিজে চলার ও দেশে থাকা মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। আমার কারণে যেন একজন মানুষও আক্রান্ত না হয়, আমি সেই দিকে ওয়াকিবহাল।
এ শহরের সঙ্গে তৈরি হয়েছে আমার কঠিন এক বন্ধন। মাঝে মাঝে মনে হয় এই শহর ছেড়ে গেলে বুঝি আমি মরেই যাবে। এই শহরকে এভাবে ভালোবেসে ফেলেছি। কারণ এই শহরে আমি অসংখ্য ভালো মানুষের দেখা পেয়েছি, যারা বিপদে-আপদে পাশে ছিলেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

এক সময় কেউ দেশে চলে গেলে চিন্তা করতাম, এই ভালো মনের মানুষটি চলে যাচ্ছেন, হয়ত এ রকম মানুষ এই শহরে আর আসবে না। কিন্তু আমার এই ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছে এমনই কিছু মানুষ। এই পৃথিবীতে অসংখ্য ভালো মানুষ আছেন, যারা আসবেন যাবেন ক্ষণিকের এই দুনিয়াতে। শুধু রেখে যান ভালো কাজের দৃষ্টান্ত।
তেমনি একটি ভালো কাজের কথা বলে শেষ করব। জেদ্দা বাংলাদেশ কনস্যুলেটের নবনিযুক্ত কনসাল জেনারেল নাজমুল হকের কথা বলছি। একদিন কনস্যুলেটের বাইরে পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এক বয়স্ক প্রবাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজে এসেছেন? ভদ্রলোক জানালেন পাসপোর্ট রিনিউ করতে এসেছেন প্রায় চারশ কিলোমিটার দূরের শহর আবহা থেকে। কনস্যুলেট নিজেই সেই প্রবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সার্ভিস দিলেন। এই রমজানেও তিনি প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ৯টায় যারা এসে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাদের প্রথম এক ঘণ্টার সার্ভিস নিশ্চিত করেছেন।
হাজারো সমস্যার মাঝে উদারতা আর নৈতিক কর্তব্য বোধের এসব উদাহরণ সত্যি মন ভালো করে দেয়। ভালো থাকুক জেদ্দা, ভালো থাকুক পৃথিবী।
এসএসএইচ