শ্রমিক অসন্তোষ ও শ্রমের অবমূল্যায়ন

সঠিক শ্রমই মানুষের জীবনে সফলতা বয়ে আনতে পারে। শ্রমই হলো উপার্জনের প্রথম পদক্ষেপ। যত বেশি শ্রম, তত বেশি আয় –এই প্রত্যাশা নিয়ে বিশ্বের শ্রমজীবীরা উপার্জনের তাগিদে বিভিন্ন পেশায়, এমনকি পথে প্রান্তরেও নিজেদের নিয়োজিত করেন।
একটি বিষয় স্পষ্ট, শ্রমের মাঝে বিভাজন রয়েছে –উচ্চ শ্রেণি ও নিম্ন শ্রেণির শ্রমিক। তার ওপর আছে আয়ের পার্থক্য। এর মধ্যেই মানুষ জীবনের চাহিদা মেটাতে আমৃত্যু কাজ করে যায়। শ্রমিকরা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় দিনরাত পরিশ্রম করে। কিন্তু কে দেয় শ্রমের সঠিক ন্যায্যতা তাদের? তবুও থেমে নেই বিশ্বের প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন শ্রমজীবী, যা ২০২৫ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্য। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই, কারণ প্রতি সেকেন্ডে জন্ম ও মৃত্যু হয়।
রিসার্চ এক্সপার্ট মি. আইনার এইচ. ডাইভিকের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ৩.৬ বিলিয়ন শ্রমজীবী ছিল। ১৯৯১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২.২৩ বিলিয়ন, অর্থাৎ প্রায় ১.৪ বিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। সূত্র বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে বিশ্বে কর্মসংস্থানের ব্যাপক হ্রাস দেখা দিয়েছিল, কারণ কোভিড-১৯ মহামারিতে অর্থনীতিতে আকস্মিক বড় ধাক্কা লাগে।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালের ৪ জুলাই প্রকাশিত অন্য একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন শ্রমজীবী ছিল। ১৯৯১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২.২৩ বিলিয়ন। এসময়ে শ্রমজীবী বেড়েছে এক বিলিয়নেরও বেশি। ২০২৩ সালের শ্রমজীবীদের মধ্যে প্রায় ২.১ বিলিয়ন পুরুষ এবং ১.৪ বিলিয়ন নারী ছিলেন।
এই শ্রমজীবীদের অধিকাংশই কোনো না কোনো শ্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। বাঁচার তাগিদে নিজের মেধা ও শ্রম বিত্তশালী মানুষদের কাছে সমর্পণ করে বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করেন। বিত্তবানরা দিনমজুরের শ্রমের বিনিময়ে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রসারিত করতে থাকেন। পরিতাপের বিষয় হলো, তারা বিনিয়োগ করে ভাগ্য পরিবর্তন করতে সক্ষম হন, আর শ্রমিকরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মহাযুদ্ধ চালালেও সংসারের অভাব মেটাতে পারেন না। সংগ্রাম করেই শ্রমিকদের জীবন কাটাতে হয়। অভিযোগ আছে, দেশের শ্রমিকরা কোনো সরকারের আমলেই শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন পায় না। বরং ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। শ্রমের ন্যায্যতার জন্য কোনো আন্দোলনে নামলে, মেহনতি শ্রমিকদের সরকারের তোপের মুখে পড়তে হয়।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে জনসংখ্যা ৮ বিলিয়ন ২শ ৩১ মিলিয়ন ৬শ ১৩ হাজার ৭০ জন। প্রতি সেকেন্ডে এ সংখ্যা পরিবর্তিত হয়। তবে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের ৫ তারিখের একটি জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যা ৮.২ বিলিয়ন। এর আগে ২০২২ সালে ছিল ৮ বিলিয়ন। এভাবেই প্রতিদিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নানাভাবে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন। তুলনামূলকভাবে ভাগ্য পরিবর্তনের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
দিন দিন এই জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তাদের জীবনের চাহিদা মেটায়। দেখা গেছে, যৌবনকালে কর্মস্থলে যোগদান করে বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলেও ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তারা লাগামহীন পরিশ্রম করে যাচ্ছে। শ্রমিক অবমূল্যায়নের একটি বড় দৃষ্টান্ত সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, যা শ্রমিকদের জন্য ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন। বছর ঘুরে এলেই শ্রমিকদের আত্মার চিৎকার বাড়ে, মনে তাদের শ্রমের যথাযথ সম্মান না পাওয়ার এবং ন্যায্য পাওনা না পাওয়ার বেদনা ফিরে আসে। মালিকপক্ষ বড় থেকে আরও বড় হয়, আর শ্রমিকরা সেই নিচুতলার মানুষই থেকে যায়।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা মে দিবস নামেই পরিচিত। প্রতি বছর ১ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠন রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করেন।
বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ মে জাতীয় ছুটির দিন এবং অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবেও পালন করা হচ্ছে। ‘হে’ মার্কেটের ট্র্যাজেডি কমবেশি সবারই জানা আছে, তাই এর বিস্তারিত পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। একটি নেতিবাচক ঘটনার মধ্য দিয়ে অধিকার আদায়ের লড়াই শুরু করেন শ্রমিকরা। ফলস্বরূপ ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের প্রস্তাব নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। এ দাবি কার্যকর করার জন্য ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। এভাবেই আন্দোলন চলতে থাকে। একাধিকবার মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানানো হলেও তাদের কাছ থেকে সামান্য সাড়াও মেলেনি। এরপর এ ঘটনা নিয়ে একটি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে বিষয়টি আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর যা হওয়ার তাই হলো, বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করলো।
শিকাগো শহর প্রতিবাদ-বিদ্রোহের একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হলো। ফলে ১ মে যতই ঘনিয়ে আসছিল, উভয়পক্ষের সংঘর্ষ তীব্র হতে শুরু করলো। মালিক-বণিকরা শ্রমিকদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো। পুলিশ আগে থেকেই শ্রমিকদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাত। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানোর জন্য ব্যবসায়ীরা পুলিশকে বিশেষ অস্ত্র কিনে দিয়েছিল। সেই সময় ১ মে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসেন, এভাবে আন্দোলন আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে শ্রমিকদের শ্রমের বিভাজন একটি সীমাবদ্ধতায় আসে। কিন্তু শ্রমের আসল মূল্য অনেকটা আগের মতোই রয়ে যায়। অবমূল্যায়নের গণ্ডি থেকে শ্রমের আসল মূল্য বেরিয়ে আসতে পারেনি। যেন লড়াই করেও শ্রমিকদের জয় নিশ্চিত হয়নি। বহু বছর তো পার হয়ে গেল, আর কবে শ্রমিকরা তাদের শ্রমের আসল মূল্য পাবে?
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব