কোরআনের যেসব আয়াত ও হাদিসে বিয়ের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে

বিয়ে মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ, স্বভাবসিদ্ধ এবং অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিয়ে কেবল একটি সামাজিক রীতি নয়, বরং স্বাভাবিক জীবনের একটি অনিবার্য প্রয়োজন। একজন মানুষ যখন মাতৃগর্ভে প্রাণের সঞ্চার লাভ করে, তখনই তার মাঝে ক্ষুধার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। অথচ তখনও সে দৃষ্টিশক্তি, বুদ্ধি বা চলনশক্তির মতো অন্যান্য বহু মানবিক চাহিদা অনুভব করতে শেখেনি। কিন্তু জীবনের প্রথমতম প্রেরণা হিসেবে তখনই তার ভেতর খাদ্যচাহিদা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
শিশুটি জন্মগ্রহণ করে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। বয়ঃসন্ধির সোপান পেরিয়ে যখন সে পরিণত বয়সে উপনীত হয়, তখন তার জীবনে নতুন নতুন চাহিদা জন্ম নিতে থাকে। এই চাহিদাগুলোর মধ্যে কিছু প্রয়োজন ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হলেও কিছু চাহিদা এমন রয়েছে, যা প্রায় প্রতিটি মানুষের জীবনেই অভিন্ন। বিয়ে তেমনই একটি চাহিদা যা মানব প্রকৃতির অন্তর্গত ও স্বভাবজাত।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে বিয়েকে মানবজাতির জন্য এক অনন্য নিয়ামত ও দয়ালু ব্যবস্থারূপে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু জগতসমূহের সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, তিনিই মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই নির্ধারণ করেছেন তাদের জীবনব্যবস্থা সুতরাং জীবনের প্রতিটি চাহিদার সঠিক ও বৈধ প্রতিপূরণও তিনিই নির্দেশিত করেছেন। বিয়ে সেই নির্দেশিত পথেরই একটি, যা মানুষকে চারিত্রিক পবিত্রতা, পারিবারিক স্থিতি ও আত্মিক প্রশান্তি দান করে।

এই ব্যবস্থা নিছক একটি মানবিক আবিষ্কার নয়, বরং তা আল্লাহর হিকমত ও কুদরতের ফল। সমাজ, সভ্যতা ও মনুষ্যত্বের ধারক এই পবিত্র বন্ধনকে আল্লাহ তায়ালা এমন এক সুন্দর কাঠামোয় স্থাপন করেছেন, যার মাধ্যমে মানুষ শান্তি ও পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। বিয়ে শুধু দাম্পত্য জীবনের শুরু নয়, বরং এটি মানুষের জন্য দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতে সওয়াবের এক মহান বাহন।
আরও পড়ুন
কোরআনের আলোকে বিয়ের গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَأَنكِحُوا الْأَيَامَىٰ مِنكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ
তোমাদের মধ্যে যারা নিঃস্ব (অবিবাহিত), তাদের বিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ, তাদেরও। (সূরা নূর, আয়াত :৩২)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি বিবাহের নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে সমাজের দায়িত্বশীলদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে অবিবাহিতদের বিয়ে দেওয়া একটি সামাজিক দায়িত্বও বটে। পবিত্রতা ও চারিত্রিক উৎকর্ষ অর্জনের জন্য বিবাহ কতটা জরুরি, তা এই আয়াতে স্পষ্ট।
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে—
وَمِنۡ اٰیٰتِہٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡہَا وَجَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّرَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্য থেকে এটি একটি যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গীণীকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের (স্বামী-স্ত্রীর) পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে, সেইসব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা রূম, আয়াত :২১)

এই আয়াতে বিয়েকে আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও শান্তির বন্ধন সৃষ্টি হয়, তা স্বর্গীয় অনুগ্রহের একটি প্রতিফলন।
হাদিসের আলোকে বিয়ের উৎসাহ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—
النِّكَاحُ من سُنَّتِي، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي
বিবাহ আমার সুন্নত। যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে অপছন্দ করে, সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়। (সহিহ ইবনু মাজাহ, হাদিস: ১৮৪৬)
এই হাদিসে বিয়েকে ইসলামী জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ বলা হয়েছে। এটি পরিত্যাগ করা যেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া। আরও এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে—
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ
হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য আছে, সে যেন বিবাহ করে। কারণ তা দৃষ্টিকে নিচু করে এবং লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করে। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
এই হাদিসে যুবসমাজকে বিয়ের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে, কারণ তরুণ বয়সে প্রবৃত্তি প্রবল থাকে, আর বিবাহ তার বৈধ ও উত্তম নিয়ন্ত্রণ।
বিবাহ: একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা
ইসলামে বিবাহ শুধু যৌন তৃপ্তি বা জৈবিক চাহিদা পূরণের উপায় নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দায়িত্ব, সন্তান জন্ম ও লালন-পালন, পারিবারিক ভালোবাসা এই সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

আল্লামা ইবন কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন, বিবাহ মানুষের জীবনের এমন একটি আবশ্যিক দিক, যা না থাকলে তার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এটি দ্বীনদারির রক্ষাকবচ এবং চরিত্রের রক্ষাকবচ।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ একটি পবিত্র, পূর্ণাঙ্গ ও সম্মানজনক চুক্তি, যা ব্যক্তিগত জীবনে স্বস্তি, সমাজে শৃঙ্খলা এবং জাতিতে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনে। কোরআন ও হাদিসে বিয়ের যে গভীর গুরুত্ব ও উৎসাহের কথা বলা হয়েছে, তা থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি বিবাহ শুধু একটি সামাজিক অনুষ্ঠান নয়; বরং এটি একটি ইবাদত, একটি আমানত এবং একটি রাসূলী সুন্নত। এ জন্যই প্রত্যেক সচেতন মুসলিমের উচিত, যথাসময়ে এই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজের চরিত্র রক্ষা করা এবং সমাজের নৈতিক স্থিতি বজায় রাখা।
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুস সুন্নাহ মাদরাসা মাতুয়াইল, ডেমরা,ঢাকা।
