যে টানে শতাব্দী ধরে জেরুজালেমে বসবাস করছেন উজবেক মুসলিমরা

জেরুজালেমের পুরোনো শহরের সংকীর্ণ গলি আর ঐতিহাসিক মসজিদগুলোতে আজও টিকে আছে উজবেক সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির ছাপ। শতাব্দী পেরিয়ে আসা এ জনগোষ্ঠী মূলত সেই এশীয় হাজিদের উত্তরসূরি, যারা ওসমানীয় আমল থেকেই পবিত্র নগরীতে এসে থিতু হন। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে তাদের অবদান আজও জীবন্ত।
উজবেকদের শেকড়
উজবেকরা ওজ বেক বা ওজ খান-এর বংশধর বলে পরিচিত—তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরি, যিনি ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করে নাম নেন গিয়াসুদ্দিন মুহাম্মদ। তার অনুসারী গোত্রগুলো মধ্য এশিয়ার নানা অঞ্চলে বিস্তৃত হয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে গড়ে তোলে বর্তমান উজবেকিস্তান প্রজাতন্ত্রের প্রধান জনগোষ্ঠী।
বর্তমানে প্রায় দুই কোটি উজবেক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন—মূলত উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান ও তুর্কমেনিস্তানে। ইতিহাসের প্রাচীন পর্বে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন পশুপালন, ঘোড়া ও উটের মাধ্যমে। উজবেকরা সাংস্কৃতিকভাবে তুর্কি ও ইরানি জাতিসত্তার এক অনন্য সংমিশ্রণ।
ইসলাম এ অঞ্চলে প্রবেশ করে হিজরি ৩১ সালে (খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী)। খ্যাতনামা ইসলামি আলেম ইমাম মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল আল-বুখারি ছিলেন এই ভূমির সন্তান।
জেরুজালেমে উজবেকদের আগমন
ওসমানীয় আমলেই উজবেকদের আগমন শুরু হয় পবিত্র নগরী জেরুজালেমে। তখন অনেকেই হজ বা ধর্মীয় সফরের পথে এসে এখানে অল্প কিছুদিন অবস্থান করতেন। বেশিরভাগই ছিলেন দরিদ্র হাজি, যারা মসজিদ বা দরগাহে রাত কাটাতেন।
তাদের জন্যই ওসমানীয় যুগে গড়ে ওঠে উজবেক জাওইয়া বা ধর্মীয় খানকাহ। সবচেয়ে বিখ্যাত হলো নকশবন্দিয়া বুখারিয়া জাওইয়া, যা আজও পুরোনো শহরের গাওয়ানিমা গেটের পাশে অবস্থিত। এটি গড়ে তোলেন বুখারা থেকে আগত সুফি আলেম শায়খ মুহাম্মদ নকশবন্দ আল-বুখারি।

এই জাওইয়াটি ছিল হজে যাওয়া বা হজ শেষে মক্কা থেকে ফেরা তুর্কি, বুখারি ও আফগান হাজিদের বিশ্রামের স্থান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু কয়েকদিনের জন্য আল-আকসা মসজিদে ইবাদত ও সফর। ওসমানীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নকশবন্দি তরিকা সেই সময় জেরুজালেমে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
এক সময় এই জাওইয়ায় প্রতিবছর মধ্য এশিয়া ও তুরস্ক থেকে ৩০ থেকে ৮০ জন হাজি আগমন করতেন। ১৯৬৭ সালের আগ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল।
তুরকান খাতুনের মাজার
জেরুজালেমে উজবেকদের আরেক ঐতিহাসিক নিদর্শন হলো তুরকান খাতুনের কবরস্থান। ‘তুরকান’ অর্থাৎ ‘মহিলা নেতা’ ছিলেন উজবেক বংশীয় এক সম্ভ্রান্ত নারী। আমির তকতাই ইবন সালজুকাইয়ের কন্যা। ইসলামী বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে তার পরিবার প্রভাবশালী ছিল।
ইতিহাসে তুরকান খাতুনের নাম এখনো শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তার কবরকে ঘিরে যে তুরবাহ বা মাজার গড়ে উঠেছে, তা উজবেকদের কাছে এখনো পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য। হাজি ও পর্যটকরা সেখানে দোয়া ও তাবারুকের উদ্দেশ্যে আসেন।
আজও টিকে আছে ঐতিহ্য
যদিও সময়ের স্রোতে উজবেকদের সংখ্যা এখন কমে গেছে, তবু তাদের ঐতিহ্য আজও টিকে আছে জেরুজালেমের পুরোনো শহরে। নকশবন্দি জাওয়িয়ার পুরোনো দরজা, তুরকান খাতুনের মাজারের দেয়ালে খোদাই করা নকশা—সবকিছু যেন সাক্ষী হয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন এ সম্পর্কের, যেখানে মধ্য এশিয়ার মানুষরা হৃদয় দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল পবিত্র নগরীকে।
সূত্র : আল-জাজিরা