কোরআনে বর্ণিত নারী শাসক রানী বিলকিসের জীবনীতে যে শিক্ষা রয়েছে

পবিত্র কোরআনের সূরা আন-নামলে আল্লাহ তায়ালা পূর্ববর্তী যুগের এক প্রভাবশালী নারী শাসকের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের সাবা রাষ্ট্রের রানী, রানী বিলকিস। প্রথমদিকে তিনি আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী না হলেও পরবর্তীতে সত্য উপলব্ধি করে আল্লাহর ওপর ঈমান আনেন। এই ঘটনা কোরআনে নারী নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা ও সত্য গ্রহণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবৃত হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা তার নবী হজরত সুলাইমান (আ.)-কে অতুলনীয় রাজত্ব দান করেছিলেন। মানুষের পাশাপাশি জিন, পশুপাখি ও প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি ছিল তার অধীন। বাতাস তার নির্দেশে প্রবাহিত হতো, তিনি পশুপাখির ভাষাও বুঝতে পারতেন। বিশাল সেনাবাহিনী ও সুবিন্যস্ত প্রশাসনের মাধ্যমে তিনি রাজ্য পরিচালনা করতেন।
একদিন সুলাইমান (আ.) লক্ষ্য করলেন, তার বাহিনীর অন্যতম ‘গোয়েন্দা পাখি’ হুদহুদ অনুপস্থিত। এতে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, যথাযথ কারণ দর্শাতে না পারলে হুদহুদকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। কিছুক্ষণ পর হুদহুদ ফিরে এসে এক বিস্ময়কর সংবাদ জানাল।
হুদহুদ জানায়, সাবা দেশে এক নারী রাজত্ব করছেন, যাকে সবকিছুই দেওয়া হয়েছে। তার রয়েছে বিশাল সিংহাসন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো—তিনি ও তার প্রজারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্যের উপাসনা করছে। শয়তান তাদের এই ভ্রান্ত কাজকে তাদের কাছে সুন্দর করে উপস্থাপন করেছে, ফলে তারা হেদায়েত থেকে বঞ্চিত।
এমন কথা শুনে সুলাইমান (আ.) সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে চান। তিনি রানী বিলকিসের কাছে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান। উত্তরে রানী বিলকিস বিপুল উপঢৌকন পাঠান। কিন্তু দুনিয়ার সম্পদের প্রতি কোনো মোহ ছিল না সুলাইমান (আ.)-এর। তিনি উপহার প্রত্যাখ্যান করে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, মানুষকে শিরক ও কুফর থেকে মুক্ত করে আল্লাহর পথে ডাকা-ই তার মূল লক্ষ্য।
তিনি বিলকিসের দূতদের বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদের দেওয়া সম্পদের চেয়ে উত্তম। তোমরা তোমাদের উপহার নিয়েই ফিরে যাও।’ একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করে দেন, সত্য প্রত্যাখ্যান করলে অপ্রতিরোধ্য বাহিনী নিয়ে তিনি আক্রমণ করবেন।
এই হুঁশিয়ারিতে বিচলিত হয়ে রানী বিলকিস সুলাইমান (আ.)-এর দরবারে উপস্থিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার আগমন উপলক্ষে আল্লাহর দেওয়া ক্ষমতার নিদর্শন দেখাতে সুলাইমান (আ.) চাইলেন, বিলকিস আসার আগেই তার সিংহাসন উপস্থিত করতে। এক শক্তিশালী জিন এবং ঐশী জ্ঞানের অধিকারী এক ব্যক্তি মুহূর্তের মধ্যেই সেই সিংহাসন এনে হাজির করেন।
সুলাইমান (আ.) সিংহাসনের আকৃতি কিছুটা পরিবর্তন করে দেন, যাতে বিলকিসের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করা যায়। দরবারে উপস্থিত হলে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, এটি কি তার সিংহাসন? তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে উত্তর দেন, ‘এটাই তো মনে হয়।’ এই ঘটনাগুলো তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে।
পরিশেষে রানী বিলকিস সুলাইমান (আ.)-এর নবুয়ত ও আল্লাহর অসীম ক্ষমতা উপলব্ধি করেন। তিনি আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণ করে বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমি নিজের ওপর জুলুম করেছি। এখন আমি সুলাইমানের সঙ্গে বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করছি।’
কিছু বর্ণনায় রয়েছে, পরবর্তীতে রানী বিলকিসের সঙ্গে হজরত সুলাইমান (আ.)-এর বিয়ে হয় এবং তিনি তার সংসারের অংশ হন।
এই ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই
- সত্য গ্রহণে বিনয়ই শ্রেষ্ঠত্ব। ক্ষমতা ও রাজত্ব থাকা সত্ত্বেও রানী বিলকিস সত্য উপলব্ধি করে বিনয়ের সঙ্গে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
- নেতৃত্ব মানেই প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিত। তিনি যুদ্ধ নয়, সংলাপ ও কূটনীতির পথ বেছে নিয়েছিলেন—যা একজন আদর্শ শাসকের বৈশিষ্ট্য।
- দুনিয়ার সম্পদ নয়, ঈমানই চূড়ান্ত সাফল্য। হজরত সুলাইমান (আ.) দেখিয়ে দিয়েছেন, নবী ও আল্লাহর ওলিদের কাছে দুনিয়ার ধন-সম্পদের কোনো মূল্য নেই; আসল লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি।