১৬ বছরে কমছেই এনএসসির কোচ

- ১৬ বছরে কোচ শূন্যতা ৬৫ শতাংশ
- ২০০৬ সালে ৪১; ২০২২ সালে ১৫ কোচ
- কোচ কমলেও বেড়েছে স্থাপনা নির্মাণ-সংস্কার
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) পুরাতন ভবনের নিচতলায় ডান পাশে কোচদের সুবিশাল কক্ষ। সেই কক্ষে এক সময় ছিল ওসমান খান, মোস্তফা কামাল, জামাল হায়দার, রাজিয়া সুলতানা অনু,কামরুন নাহার হীরুদের মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের অবস্থান। ফলে এনএসসির কোচদের কক্ষ ছিল তারকাদের হাট ও ক্রীড়াঙ্গনের নানা শ্রেণীর মিলনমেলা। সময়ের বিবর্তনে সেই কক্ষ এখন যেন ভাঙা হাট!
কক্ষে প্রবেশদ্বারের গা ঘেষেই এক বোর্ডে টানানো বিভিন্ন খেলায় প্রশিক্ষকের নামের তালিকা। এক যুগের বেশি সময় আগে সেই তালিকায় ১৮ খেলায় কোচের সংখ্যা ছিল ৪১ জন। ২০২২ সালে সেই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে এখন ১৩ খেলায় ১৫ জন। এর মধ্যে আবার দুই জন কোচ ক্রীড়া প্রশাসনে যুক্ত ফলে কার্যত কোচ মাত্র ১৩ জন।

২০০৬ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে সর্বশেষ কোচ হিসেবে যোগদান করেছিলেন দাবাড়ু আবু সুফিয়ান শাকিল, ভারত্তোলক শাহরিয়া সুলতানা সূচি ও ভলিবলের ইমদাদুল হক মিলন। এরপর ১৬ বছরে অনেকে অবসর নিয়েছেন। সেই পদগুলো শূন্য হলেও পূরণ করেনি এনএসসি। শাকিলদের নিয়োগের পর গত এক যুগে কয়েক বার কোচ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েও এনএসসি শূন্য পদ পূরণ করতে পারেনি।
আট বছর আগে ফুটবল কোচ পদে আবেদন করেছিলেন গোলরক্ষক কোচ নুরুজ্জামান নয়ন। সেই আবেদন এখনো আবেদনের পর্যায়ে থাকলেও এর মধ্যে তিনি জাতীয় দলে গোলরক্ষক কোচ হিসেবে কাজও করে ফেলছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কোচ নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ, ‘একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া এত দিন সময় লাগলে সেটা অবশ্যই দুঃখজনক। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কোচ নিয়োগে আবেদনে বয়সসীমা ৩০ বছর। বিভিন্ন দলীয় ও ব্যক্তিগত খেলায় ৩৫ বছর পর্যন্ত খেলোয়াড়রা অংশগ্রহণ করে। এরপর অনেকে কোচিং লাইনে আসে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চাহিদা ডিপ্লোমা। কিন্তু বর্তমান সময়ে ফুটবলে এএফসির লাইসেন্স হলো কার্যকরী। অন্য খেলায় স্ব স্ব লাইসেন্স রয়েছে।’
আবেদনের বয়সসীমা, ডিগ্রির পাশাপাশি এনএসসি কোচদের আরেকটি সংকট মর্যাদা। কোচদের নিয়োগ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে দ্বিতীয় শ্রেণীর। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত আরেকটি প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির কোচরা আবার নিয়োগ পান প্রথম শ্রেণিতেই। নিয়োগের দীর্ঘসুত্রিতা, মর্যাদা সংকট সহ নানা সমস্যায় অনেক দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিরা ক্রীড়াঙ্গনের অন্য ক্ষেত্রে নিজেদের পেশাস্থল ঠিক করেছেন৷
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ নিয়োগে বিদ্যমান সংকট সম্পর্কে আইন কর্মকর্তা কবিরুল হাসানের ব্যাখ্যা, ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কোচদের চাকরি সরকারি তাই অন্য সরকারি চাকরির মতো এখানেও আবেদনের সময়সীমা ৩০ বছর। খেলোয়াড় ও কোচদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি অত্যন্ত যৌক্তিক। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদও সেটা অনুধাবন করে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ চলে অ্যাক্টের মাধ্যমে। সেই অ্যাক্ট জাতীয় সংসদ থেকে পাশ হয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিয়োগ বিধিমালা ১৯৯৫ আইন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চাকরি নীতিমালা পরিবর্তন-সংযোজন করার এখতিয়ার নেই; সেই এখতিয়ার আইন মন্ত্রণালয়ের। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী কমিটি কোচদের এই বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছে।’
ভারত্তোলন ফেডারেশনের বর্তমান সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক পরিচালক। দীর্ঘদিন কোচ নিয়োগ না হওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘খেলাধূলায় কোচরা চালিকাশক্তি। তারা খেলোয়াড় তুলে আনে ও মান উন্নয়ন করে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অন্যতম উদ্দেশ্য কোচদের মাধ্যমে তৃণমূলে খেলোয়াড় তুলে আনা ও ফেডারেশনে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সাহায্য করা। কোচ সংকটে সেই ধারা ব্যহত হচ্ছে। এক যুগের বেশি সময় কোচ নিয়োগ না হওয়া মানে এই ব্যাপারে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না।’
গত এক যুগের বেশি সময় কোচ নিয়োগ না হলেও এই সময় বিভিন্ন সংস্কার, স্থাপনা হয়েছে অনেক। ফলে বোঝা যায় জাতীয ক্রীড়া পরিষদের ক্রীড়া কোচ,প্রশিক্ষণের চেয়ে অন্য দিকে মনোযোগ বেশি।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচদের দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক ভুমিকা। আজকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই অবস্থানের ভিত রচনা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচদের মাধ্যমেই। আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন সহ আরো অনেক তারকা খেলোয়াড়দের কোচ ওসমান খানের হাতে গড়া। ওসমান খান বাংলাদেশের ক্রিকেটে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচের অবদান সম্পর্কে বলেন, ‘আজকের ক্রিকেট বোর্ড আর ২৫ বছর আগের বোর্ড এক ছিল না। আশির দশক থেকে ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচের উপর নির্ভরশীল ছিল। জাতীয় দলের প্রায় ক্যাম্পে এনএসসির কোচই ছিল,বিদেশি কোচ আসলে তাদের সহকারী হিসেবে এনএসসি কোচরাই ছিল।’ ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিতে গর্ডন গ্রিনিজের সহকারী কোচ হিসেবে ছিলেন ওসমান খান ও জালাল আহমেদ চৌধুরী।
সেই ক্রিকেট বোর্ড এখন অনেক সাবলম্বী। হাজার হাজার ডলার খরচ করে বিদেশি কোচ রাখে। প্যানেলভুক্ত দেশীয় কোচও অনেক । ফুটবল ফেডারেশনের এত অর্থ না থাকলেও এএফসির অর্থায়নে ফুটবলে দেশীয় কোচের সংখ্যা বিশের কাছাকাছি। ফুটবল, ক্রিকেট সাবলম্বী হলেও অনেক ফেডারেশনের বিদেশি কোচ তো দূরে দেশীয় কোচ রাখার সামর্থ্য হয়ে উঠেনি। সেই সকল ফেডারেশন এখনো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচদের উপরই নির্ভরশীল।
এনএসসি নতুন দশজন কোচ নিয়োগ দেবে। সেই দশ জনের মধ্যে তিন জন কোচ ফুটবল ও ক্রিকেটের ( ফুটবল, সাতার অ্যাথলেটিকস ২ জন করে আরচ্যারি, হকি, ক্রিকেট, বাস্কেটবলে একজন করে) । ফুটবল ফেডারেশন সাবলম্বী হলেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন এনএসসির সাবেক কোচ মোশাররফ বাদল, ‘আমি ও স্বপন এক সঙ্গে অবসরে গিয়েছি। ২০১৬ সাল থেকে ফুটবলে এখন কেউ নেই। কোচ না থাকায় ফুটবলে প্রতিভা অন্বেষণও হয় না। খেলোয়াড়রাও উঠে আসছে না।’
যদিও ক্রীড়াঙ্গনের অনেকের প্রশ্ন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অন্বেষণ থেকে খেলোয়াড় সেই মাত্রায় উঠে আসে না। তারপরও কিছু খেলোয়াড় আসে বলে মত অনেক দিন এই দায়িত্বে থাকা বাদলের, ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ একবার গোলরক্ষকদের নিয়ে প্রতিভা অন্বেষণ করেছিল। সেই অন্বেষণ থেকে খেলোয়াড় এসেছে। ফুটবল ফেডারেশনের কোচ থাকলেও পর্যাপ্ত নেই। ফলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহায়তা নিত। প্রায় ক্ষেত্রে যৌথ অন্বেষণ হতো।’
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনেক কোচ ফেডারেশন,ক্লাব ও সংস্থায় কোচিং করায়। এর ফলে কোচদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়তি সুবিধা পায় এই প্রসঙ্গে এনএসসির সাবেক কোচ মোশাররফ বাদলের মন্তব্য, ‘এতে কোচরা কিছু অংশে লাভবান হচ্ছে সত্যি। তবে সেটা নিয়ম অনুমতির মাধ্যমে। অনেক ক্লাব, সংস্থা খেলার প্রয়োজনে কোচ চায়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অনুমতি দিলে সংশ্লিষ্ট কোচ কাজের অনুমতি পায়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোনো প্রোগ্রাম না থাকলে অনুমতি দেয় অন্যথায় নয়।’
অন্বেষণ থেকে খেলোয়াড় যোগান পাওয়া যায় বলে মত দাবার কোচ শাকিলেরও, ‘২০০৬ সালে আমি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে যোগদান করেছি। এরপর থেকে তৃণমূলে অন্বেষণ করে পাওয়া অনেক দাবাড়ু জাতীয় পর্যায়ে খেলেছে। যা আগে ছিল না। প্রতি বছর আমরা ছয়টি জেলায় অন্বেষণ করি। ছয় জেলায় প্রতিভাবান কয়েকজন খেলোয়াড় পাই। সেই খেলোয়াড়দের তালিকা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও ফেডারেশনে দেয়া হয়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এই তালিকা ব্যবহার করে খেলোয়াড়দের ডাকা হয়। এর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে অনেকেই খেলে।’
দাবা দেশের সম্ভাবনাময় এক খেলা। সেই খেলার জন্য এনএসসি কোচ নিয়োগ দিয়েছে ২০০৬ থেকে। তাও মাত্র ১ জন। ব্যাডমিন্টন, শুটিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলায় এনএসসি কখনো কোচ রাখেনি। এবার বিজ্ঞপ্তিতে সম্ভাবনাময় খেলা আরচ্যারির একজন কোচ চেয়েছে। নতুন বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ হলেও কুস্তি, টেবিল টেনিস, টেনিসে শূন্যতা থেকেই যাবে।
এক যুগের বেশি সময় কোচে কোনো নিয়োগ নেই, শুধু বিজ্ঞপ্তির পর বিজ্ঞপ্তি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বর্তমান সচিব পরিমল সিংহ জানুয়ারিতে এসেছেন। এনএসসিতে তিনি অতি স্বল্প সময় হলেও তিনি এক যুগের বেশি সময়ের দীর্ঘসূত্রিতা ভাঙতে চান,‘ কোচ সহ আরো বেশ কিছু পদে নিয়োগ প্রয়োজন। আমরা ইতোমধ্যে আবেদনগুলো পর্যালোচনা করছি। খুব শীঘ্রই নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধাপগুলো অনুসরণ করব। চেয়ারম্যান মহোদয়ও (যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী) নিয়োগ সম্পন্ন করার ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী।’
ইমাম,মালী সহ অন্য প্রশাসনিক পদও শূন্য দীর্ঘদিন থেকে। ক্রীড়াঙ্গনের চালিকা শক্তি কোচ। বছরে বছরে বিভিন্ন খেলার কোচরা অবসরে যাওয়ায় এনএসসি অনেক খেলায় কোচশূন্য হয়ে পড়ছে৷ এর প্রভাব পড়ছে ক্রীড়াঙ্গনে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ হিসেবে আছেন যারা
ক্রিকেট: শফি কামাল স্বপ্নীল
সাঁতার: গোলাম সারওয়ার
সাইক্লিং: সাহিদুর রহমান
কাবাডি: আব্দুল জলিল
হ্যান্ডবল: কামরুল ইসলাম
বাস্কেটবল: মিজানুর রহমান
জুডো: একে এম আজাদ
বক্সিং: আতিয়ার রহমান
হকি: মোবারক করিম লিটন (প্রশাসক বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম)
জিমন্যাস্টিকস: নুরুজাহান বেগম হীরা
ভারত্তোলন: শাহরিয়া সুলতানা
ফারুক সরকার (উপ-পরিচালক)
ভলিবল: জহুরা বেগম তূর্ণা
ইমদাদুল হক মিলন
দাবা: আবু সুফিয়ান শাকিল
এনএসসি কোচ হিসেবে বিগত সময়ে যারা কাজ করেছেন এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
সৈয়দ আলতাফ হোসেন, ওসমান খান, আব্দুল হাদী রতন, জালাল আহমেদ চৌধুরী (ক্রিকেট), আনজাম হোসেন, আব্দুস সাদেক, কাজী সাত্তার, স্বপন কুমার দাস, শামসুদ্দোহা চান, মোশাররফ বাদল (ফুটবল), রাজিয়া সুলতানা অনু, ইয়াহিয়া, আব্দুল্লাহ হেল কাফী, আব্দুল করিম (অ্যাথলেটিকস), কামরুন্নাহার হিরু (জুডো), আব্দুল মালেক চুন্নু, জামাল হায়দার (হকি), মোস্তফা কামাল, ফরিদা বেগম (ভলিবল), খুরশিদা আক্তার খুশি (জিমনাস্টিক), নাসিরউল্লাহ লাভলু (হ্যান্ডবল), প্রাণ কৃষ্ণ (টেনিস) হাফিজুর রহমান (টেবিল টেনিস), মোকসেদুর রহমান, এরশাদুন্নবী, মাহমুদুর রহমান (সাঁতার), মিজানুর রহমান, মাহতাবুর রহমান (বাস্কেটবল)।
এজেড/এটি
