প্রথম ক্রীড়া সচিবের সম্মানী ছিল এক টাকা

বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ। শরীর মাঝে মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে চাইলেও মনের কাছে হার মানছে বারবার। আজ (মঙ্গলবার) ২ মার্চ নব্বইয়ে পা দিলেও মুহূর্তের মধ্যেই সাবলীলভাবে ৬০ বা ৭০ দশকের স্মৃতির পাতা উল্টাচ্ছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (এখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ) প্রথম সচিব কাজী আনিসুর রহমান।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। ৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব, অলিম্পিক গেমসে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, বাফুফের ফিফা, এএফসি’র সদস্য পদ পাওয়ার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আনিসুর রহমানের। ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সচিব থাকাবস্থায় ১৮টি ক্রীড়া ফেডারেশন গঠন তার হাতেই।
হকির কর্মকর্তা ইউসুফ আলীর নেশা প্রবীণ ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ও সংগঠকদের খোঁজ-খবর রাখা। সেই নেশা থেকেই আজ কাজী আনিসুর রহমানের ৯০ তম জন্মদিন পালনের উদ্যোগ নেন তিনি। এই উপলক্ষ্যে অনেকেই খানিকের জন্য পেলেন ক্রীড়াঙ্গনের সত্তর-আশির দশকের স্বাদ।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা) সরকারি প্রতিষ্ঠান। পরিষদের সচিব বিসিএস ক্যাডার থেকেই নিয়োগ প্রাপ্ত হন। বিসিএস ক্যাডার না হয়েও কিভাবে সচিব হলেন সেই গল্প বললেন আনিসুর, ‘‘ইউসুফ আলী তখন ক্রীড়া, শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী। দেশের ক্রীড়ার দেখভালের জন্য একজন সচিব নিয়োগ করবেন। আমি ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনে থাকায় অনেক জায়গা থেকে আমার নাম মন্ত্রীর কাছে গিয়েছিল। উনি আমাকে একদিন ডেকে ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দায়িত্ব নিতে বলেন। আমি বলেছিলাম,‘ মাফ করবেন স্যার। আমি ব্যবসা করি সময় দিতে পারব না। ব্যবসায়ে অনেক ক্ষতি হচ্ছে।’’
‘‘পরে উনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী অফিসে নিয়ে গেলেন। তাজউদ্দিন আহমেদ আমাকে চিনতেন। ক্রীড়ামন্ত্রী বলছিলেন, ‘সে দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না।’ তখন তাজউদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘জিনিস গেলে, জিনিস আসবে। দেশ গেলে আর আসবে না। দেশের যুব সমাজ ও খেলাধুলাকে বাঁচাতে দায়িত্ব নিতে হবে।’ এই কথা বলার পর আর না করতে পারিনি।’’
দায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ার পর এখন পদ মর্যাদা, বেতনাদি, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা। ডেপুটি সিনিয়র সেক্রেটারি পদ মর্যাদা নিয়ে নিয়োগ পাওয়ার পরেও মাত্র এক টাকা সম্মানী নেয়ার ব্যাখা দিলেন আনিসুর, ‘সকাল আটটা থেকে দশটা এবং বিকেল ছয়টা থেকে রাত আট-নয়টা পর্যন্ত সময় দেব। এর মাঝে সময় দিতে পারব না। আর আমি কোনো বেতন নেব না। এজন্য সম্মানী হিসেবে চুক্তি করি মাসিক ১ টাকা।’
স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ক্রীড়াঙ্গনের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ‘অনেক প্রতিকূলতা ছিল,এর মধ্য দিয়েই এগিয়ে গিয়েছি। ফুটবলও আসতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। ক্রীড়া অফিস ঠিক করা, ক্রীড়া সামগ্রি আনা অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল।’
১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (বিকেএনএস) সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর তিন মাস পরেই ১৩ মে বাংলাদেশ একাদশ ও মোহনাবাগান ঢাকায় ম্যাচ খেলে। মোহনবাগানের বাংলাদেশ আগমনের মজার ঘটনা জানালেন তৎকালীন সচিব, ‘ভারত গিয়ে প্রথমে ইস্ট বেঙ্গলকে প্রস্তাব দেই, তারা অনেক দাবি-দাওয়া জানায়। এরপর মোহনবাগানে যাই।’
মোহনবাগানের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক এক কথায় রাজি হয়ে বললেন, ‘আমরা বাংলাদেশে যাব, খেলব। কোনো কিছু লাগবে না, শুধু ইলিশ খাওয়াবেন।’ মোহনবাগান আসার ছয় মাস পর অবশ্য ইস্ট বেঙ্গলও এসেছিল।
৭২ সালের ঐতিহাসিক তিনটি ম্যাচেই খেলেছিলেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের মহীরুহ। আনিসুর রহমানের ৯০তম জন্মদিনে এসে নিজের একেবারে বাল্যজীবনে ফিরে গেলেন প্রতাপ, ‘আমাদের বাসা ছিল আরমানীটোলা। আনিস ভাইও সেখানে থাকতেন। আমার ক্রীড়াঙ্গনের অনেক কিছুর পেছনে তার অবদান রয়েছে।’
শুভেচ্ছা জানাতে এসে হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান কোহিনূর বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ভিত আনিস ভাইয়ের হাতে গড়া। আনিস ভাই শতায়ু হোক সেটাই কামনা।’
অসুস্থ শরীর নিয়েও সাবেক দ্রুততম মানবী রওশন আক্তার ছবিও এসেছিলেন। তার দৃষ্টিতে আনিস এমন, ‘পাকিস্তান আমল থেকেই আমি অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে যুক্ত। আনিস ভাই ক্রীড়া সচিব হওয়ার পর নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে আনার জন্য বিশেষভাবে কাজ করেছেন।’
আনিসুর রহমানের ছোট্ট বাসায় যার মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনের মিলনমেলা সেই ইউসুফ আলী বলেন, ‘আনিস ভাইয়ের মাধ্যমে আমি অনেক কিছু শিখেছি। বিশেষ করে ক্রীড়াঙ্গনের কেউ অসুস্থ হলে খোজ খবর নেওয়া, সম্ভব হলে সশরীরে যাওয়া।’
ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সচিব ব্যক্তিগত জীবনে সুখি। স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। ছেলে-মেয়ে উভয়ই প্রবাসী। ৯০ বছর বয়সে এসে তার ক্রীড়াঙ্গনের ব্যক্তিদের কাছে একটাই চাওয়া, ‘আমাদের সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে অনেক সমস্যা ছিল। তারপরও সবার মধ্যে একটা বন্ধন ছিল, সবাই একটা পরিবার। এখন মনে হয় সেটা অনেক কম গেছে। আমার একটাই চাওয়া ক্রীড়াঙ্গন ও ক্রীড়া পরিবারের বন্ধন যেন অটুট থাকে।’
আনিসুর রহমান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিবের দায়িত্ব ছাড়াও বিভিন্ন ফেডারেশনের বিভিন্ন পদে ছিলেন, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের দশ বছর সভাপতি ছিলেন। ক্রীড়াঙ্গনে তার অবদানের জন্য ২০০৭ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পান।
এজেড/এমএইচ
