টস জিতেও ফিল্ডিং নেওয়ার চরম মূল্য দিলো নিউজিল্যান্ড!

চলতি বিশ্বকাপে একটি বিষয় ওপেন সিক্রেট, তা হলো— টস জিতলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভুলেও আগে ব্যাটিংয়ে পাঠানো চলবে না! সে কারণে প্রতিপক্ষ যে-ই থাকুক প্রোটিয়াদের বিপক্ষে আগে ব্যাটিং পাওয়ার আশায় থাকতে দেখা যায়। কিন্তু আগে ব্যাট না করার ভুলটাই কি করে বসলেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক টম ল্যাথাম! এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার নেওয়া ৩৫৭ রান তাড়া করতে নেমে মুখ থুবড়ে পড়ে তাদের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ। ন্যূনতম লড়াইও দেখাতে না পারা কিউইদের ১৯০ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছে প্রোটিয়ারা।
বিশ্বকাপের ৩২তম ম্যাচে আজ (বুধবার) পুনের ইকানা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় দুই হেভিওয়েট দল— দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড। কিন্তু যে ধারণা নিয়ে ক্রিকেটবিশ্ব ম্যাচটি দেখতে বসেছিল, দু’দলের লড়াই সেভাবে জমে উঠেনি। বড় রানতাড়ায় ন্যূনতম লড়াইও দেখাতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। বলতে গেলে প্রোটিয়াদের রানচাপায় পিষ্ট হয়েছে কিউইরা।
এর আগে টস জিতে টম ল্যাথাম কেন আগে ফিল্ডিং নিলেন, তা নিয়ে ক্রিকেট মহলে আলোচনা শুরু হয়। অথচ টুর্নামেন্টজুড়ে আগে ব্যাট করা প্রোটিয়ারা কী তাণ্ডব চালিয়ে আসছে তা অজানা নয় কারো-ই। বিপরীতে রানতাড়ায় বাভুমার দলকে সংগ্রাম করতেই দেখা যায়। প্রোটিয়া অধিনায়ক নিজেও বলেছিলেন যে, প্রতিপক্ষকে বড় লক্ষ্য ছুড়ে দেওয়ায় তার দল যতটা পটু রানতাড়ায় তারা এখনও চাপ নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি।

বড় লক্ষ্য তাড়ায় আগের ম্যাচেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দারুণ লড়াই দেখিয়েছিলেন রাচিন রবীন্দ্র ও জিমি নিশামরা। যদিও ৩৮৮ লক্ষ্যের বিপরীতে তাদের ইনিংস থেমে যায় ৩৮৩ রানে। রান উৎসবের বিশ্বকাপে কিউইরা প্রতি ম্যাচেই যে এরকম দক্ষতা দেখাতে পারবেন– সেটি ভাবনায় আনা অবিশ্বাস্যই বটে! যার প্রমাণ আজকের ম্যাচে মিলেছে। বড় লক্ষ্যের জবাবে নিউজিল্যান্ড ওপেনাররা শুরু থেকেই ছিলেন নড়বড়ে। বাঁ-হাতি ব্যাটার ডেভন কনওয়ে ইনিংসের মাত্র তৃতীয় ওভারেই ফিরে যান। তখন তাদের দলীয় রান ছিল মাত্র ৮। মার্কো জানসেনের এক্সট্রা বাউন্স খাওয়া বলটি খেলতে গিয়ে স্লিপে ধরা পড়েন কনওয়ে।
ব্যাট হাতে দারুণ ছন্দে থাকা রাচিন রবীন্দ্রও আজ কিছু দেখাতে পারেননি। আবারও একই প্রোটিয়া পেসারের বলে ফাইন লেগে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ৯ রানেই তালুবন্দী রবীন্দ্র। বড় লক্ষ্য তাড়ায় মাত্র ৪২ রানেই দুই উইকেট হারিয়ে নিউজিল্যান্ড চাপে পড়ে যায়। এরপর তাদের বিপদ আরও বাড়ে ২৩ রানের ব্যবধানে উইল ইয়ং ও অধিনায়ক ল্যাথামকে হারিয়ে। যদিও ইয়ং কিছুক্ষণ থিতু হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। জেরাল্ড কোয়েটজের বলে তার ইনিংস থামে ৩৩ রানে। ব্যাট হাতে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যর্থ ল্যাথাম কাগিসো রাবাদার বলে ফিরেন মাত্র ৪ রান করে।
নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং বিপর্যয়ের বিপরীতে গতির ঝড় তোলেন জানসেন-রাবাদা। অন্যদিকে কেশব মহারাজ উইকেট থেকে পাওয়া দারুণ সুইং কাজে লাগিয়েছেন। ফলে দলীয় রান একশ উঠতেই ৬ উইকেট হারিয়ে বসে কিউইরা। সে হিসেবে তাদের পরাজয় দেখাটা ছিল মাত্র কিছু সময়েরই ব্যাপার। যদিও শেষদিকে হারের ব্যবধান কমিয়েছেন গ্লেন ফিলিপস। শেষ উইকেট পতনের আগপর্যন্ত ক্রিজে থেকে তিনি চার-ছক্কায় কিছুটা বিনোদন দেন।

কোয়েটজের বলে ক্যাচ দেওয়ার আগে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৬০ রান করেন ফিলিপস। ৫০ বলের ইনিংসে তিনি চারটি করে চার ও ছয়ের বাউন্ডারি খেলেন। মাঝে ২৪ রান করেন ড্যারিল মিচেল। এছাড়া সেভাবে আর কোনো কিউই ব্যাটারই রান পাননি। ফলে ৩৫.৩ ওভারেই তারা ১৬৭ রানে অলআউট হয়ে যায়।
প্রোটিয়াদের হয়ে ৪৬ রানে (৯ ওভার) সর্বোচ্চ ৪ উইকেট নেন স্পিনার কেশব মহারাজ। এছাড়া জানসেন তিনটি, কোয়েটজে দুটি এবং রাবাদা একটি শিকার করেন। যা ভারতকে হটিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে তুলে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে রেকর্ডগড়া সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন কুইন্টন ডি কক। তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছালেন রাসি ফন ডার ডুসেনও। এই দুই সেঞ্চুরিয়ানের ২০০ রানের জুটিতে শুরুটা দাপুটে হয় দক্ষিণ আফ্রিকার। শেষ দিকে ঝড় তোলেন ডেভিড মিলার। তাতে সাড়ে তিনশো ছাড়ায় প্রোটিয়াদের সংগ্রহ।

অবশ্য দুর্দান্ত ফর্মে থাকা প্রোটিয়া ব্যাটারদের আটকে রাখার কম চেষ্টা চালায়নি কিউই বোলাররা। দুই সেঞ্চুরির পরও ৪০ ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার রান ছিল ২৩৮। শেষ ১০ ওভারে মিলার ঝড়ে ১১৯ রান যোগ করে তারা। এর মধ্যে খেলা চলাকালে পেসার ম্যাট হ্যানরির চোট অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে নিউজিল্যান্ডকে।
অবশ্য এদিন মন্থর গতিতে ইনিংস শুরু করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ইনিংসের নবম ওভারে যখন প্রোটিয়া অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা আউট হন তখন দক্ষিণ আফ্রিকার রান ৩৮। প্রথম পাওয়ার প্লেতে ১ উইকেট হারিয়ে ৪৩ রান সংগ্রহ করে তারা। এরপরের গল্পটা ডি কক আর রাসি ফন ডার ডুসেনের। দুজনে মিলে শেষ পর্যন্ত ১৮৯ বলে ২০০ রানের বড় জুটি গড়েন। দুজনই নিজেদের ইনিংস সেঞ্চুরি পর্যন্ত নিয়ে গেছেন।
বিদায়ের মঞ্চটা রাঙিয়ে যাচ্ছেন ডি কক। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, চলতি আসর দিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতি টানবেন। শেষ আসর খেলতে নেমে বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে ভাঙছেন একের পর এক রেকর্ড। আজ ইনিংসের ৩৬ ওভারের শেষ বলে জিমি নিশামকে সপাটে ছক্কা হাঁকিয়ে ১০৩ বলে চলতি আসরে নিজের চতুর্থ শতরান পূর্ণ করেন।

সেই সঙ্গে এক বিশ্বকাপে চার সেঞ্চুরির রেকর্ডে লঙ্কান কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারার (২০১৫ বিশ্বকাপ) পাশে বসলেন ডি কক। আর একটি সেঞ্চুরি হলেই ছুঁয়ে ফেলবেন রোহিত শর্মার এক আসরে (২০১৯ বিশ্বকাপ) সর্বোচ্চ পাঁচ সেঞ্চুরির রেকর্ড। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এবারের আগে বিশ্বকাপে ডি ককের শতরানের ইনিংস ছিল না একটিও।
সেঞ্চুরি পূর্ণ করার পর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি অবশ্য। সাউদির অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে গ্লেন ফিলিপসের তালুবন্দি হন তিনি। সাজঘরে ফেরার আগে ১১৬ বলে ১০ চার ও তিন ছক্কায় ১১৪ রান করেছেন। ডি ককের পরপরই টুর্নামেন্টে নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি হাঁকান ডুসেন। সাউদির বলে যতক্ষণে আউট হন, তার আগেই খেলেছেন ১১৮ বলে ৯ চার ও ৫ ছক্কার মারে ১৩৩ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস।
শেষটা রাঙালেন ডেভিড মিলার। একজন আদর্শ ফিনিশার হিসেবে ৩০ বলে ৫৩ রানের দারুণ এক ইনিংস উপহার দিয়েছেন। তার ইনিংসে ভর করেই সাড়ে তিনশো ছাড়ায় প্রোটিয়াদের সংগ্রহ।
এএইচএস