আরও একবার ‘শচীইইন, শচীইইইইন’

এই লেখাটা শচীনের জন্য, এই লেখাটা তাদের জন্য, যারা আরও একবার ‘শচীইইন, শচীইইইইন’ করতে চান। অথবা তাদের জন্য, যাদের কাছে শচীন এক জাদুকর; ব্যাটের, জীবনেরও। অথবা এই লেখাটা শচীনের জন্য, যার আজ জন্মদিন!
গ্রামের বাজারের নির্দিষ্ট একটা দিন থাকে। হাট বসার দিন। যেদিন শাক-সবজি বেশি থাকে, মাছের মজুদ বেড়ে যায়। সপ্তাহের ওই একটা দিন গরু জবাই হয়। উৎসব উৎসব ভাব চলে আসে কয়েক গ্রামে। থাকে আরও নানান কিছু। আর থাকে জাদু। জাদুকরের জাদু।
বাজারের একটা কোণে, যেখানে একটু ফাঁকা জায়গা থাকে। ছোট ছোট ছেলেরা জটলা পাঁকায় সেখানে, থাকেন বৃদ্ধ কিংবা যুবকরাও। জাদুকর জাদু দেখান, বলেন ‘হাত তালি দাও, নয়তো জাদু কাজ করবে না’। সবাই জোরে জোরে হাত তালি দেয়, মুগ্ধ নয়নে জাদুকরের জাদু দেখে।
***
আপনি ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের দারোয়ান, মাঠকর্মী অথবা কোনো একটা দায়িত্বে। ভারতের নাগরিক, অথবা অন্য কোনো দেশের। ক্রিকেট হাসেন, ঘুমান, খান প্রকৃতির কেউ অথবা টুকটাক দেখা লোক। আপনার জাদুকর কে?
অন্তত মুম্বাইয়ে, ভারতে আপনার জাদুকর শচীন, অবশ্যই শচীন। আপনার ঘরে নিশ্চয়ই শচীনের একটা ছবি থাকবে। স্ত্রী হয়তো সকাল-সন্ধ্যা পূজা করেন তাতে! না হলে অবশ্যই যৌক্তিকভাবে আপনার ও পরিবারের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে যেতে পারে!
অথবা আপনি ভারতীয় নন, বাংলাদেশি। আপনাদের একটা সাদা-কালো টিভি ছিল, রঙিন হয়ে গেছে যেটা এর মধ্যে। তবে বিদ্যুৎটা ঠিকঠাক মতো থাকে না, ডিশ লাইনে চ্যানেল পাওয়া যায় দশটা। শচীন নামের জাদুকরকে দেখতে এক গ্রাম দূরে ছুটে যান রাত-বিরাতে, আপনার বয়স তখন সবে দশের ঘরে। মা হয়তো আপনাকে খুঁজে বেড়ান সবখানে। আপনি জানেন, বেদম মার অপেক্ষায়, তবুও ওই গ্রাম থেকে ফিরে আসেন না, জাদুকরকে দেখবেন বলে!
আপনার জাদুকর আড়ালে চলে গেছেন অনেক বছর ধরেই। এখন তিনি কোট-টাই পরে ঘুরে বেড়ান। প্যাড থাকে না আর, গ্লাভস থাকে না হাতে। জাদুকরের বয়স হয়ে গেছে, জাদুকর মাঝেমধ্যে খেলতে নামেন লিজেন্ডস প্রিমিয়ার লিগের মতো টুর্নামেন্টে। কিন্তু আপনার হয়তো তাতে মন ভরে না। তাই জাদুকরের জন্মদিনে তার ফ্রেমবন্দি হওয়া পাঁচ মুহূর্ত নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া...
***
এক ছবিতে কতটুকু দুঃখ লুকিয়ে রাখা যায়? শচীন হয়তো এই ছবিটা দেখলে চিৎকার করে বলতে চাইবেন, ‘দেখো, দুঃখ তো এভাবেও লুকানো যায়!’ বাবা নামের ছায়া হারিয়েছিলেন বিশ্বকাপের আগে। সেই বাবা যিনি বলেছিলেন, ‘ভালো মানুষ হতে হবে, সফল হতে খোঁজা যাবে না শর্টকার্ট পথ’।
তখন বিশ্বকাপ চলছে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরে গেছে ভারত। এমন সময়ই শুনলেন খবরটা। বাবা রমেশ টেন্ডুলকার আর নেই। শচীনের মন আর মানে না। ইংল্যান্ড থেকে ছুঁটে চলে আসলেন ভারতে, বাবার শেষকৃত্যে।
তিনি ভারতে থাকতেই শুনলেন, জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে গেছে তার দল। সমীকরণটা এখন এমন- পরের পর্বে যেতে জয় দরকার বাকি তিন ম্যাচের সবগুলোতে। আবার ছুটে গেলেন ইংল্যান্ডে। ক্রিকেটের মাঠে নামতে, যেটা বাবা রমেশ চাইতেন খুব করে। গিয়ে দেখলেন, তার ব্যাটিং পজিশন এখন চারে নেমে গেছে।

তাতে কীইবা যায় আসে? সেঞ্চুরি করলেন, অপরাজিত থাকলেন ১৪০ রানে। শচীন ভারতকে জেতালেন ৯২ রানের বিশাল ব্যবধানে। পরের দুই ম্যাচেও জিতে ভারত গেল সুপার সিক্স পর্বে। আর কেনিয়ার বিপক্ষে শচীনের এই সেঞ্চুরি হয়ে থাকল ক্রিকেটের ‘শোককে শক্তি’ বানানোর উদাহরণ হয়ে।
***
ক্রিকেট ও রেকর্ড। আরও একবার তোমাকে নিজের করলাম...
শচীন কি এমন কিছু বলছিলেন তখন? সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে শচীনের এই হাসিহীন মুখটাতেও ভিন্ন রকম এক খেলার স্বাদ আছে। ধোনি যেমন, ছবিটাতে প্রতিচ্ছবি হয়ে আছেন দর্শকদের ‘ওয়াও’ রিয়্যাকশনের।
কিন্তু শচীন নির্লিপ্ত। তিনি কি জানেন কী করেছেন মাত্রই? প্রশ্নটা বোকা বোকা, তবে উত্তর বিস্ময়কর। ডাবল সেঞ্চুরি! ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি করেছিলেন এমন কিছু, পঞ্চাশ বছরেও যা এর আগে ওয়ানডেতে দেখেনি কেউ।

পরে অবশ্য অনেকেই করেছেন। অনেকে মানে, পাঁচজন। তবে এই যে শচীন নির্লিপ্তভাবে ব্যাট আর হেলমেট উঁচিয়ে আছেন, ধোনি তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন পুরো বিশ্বের প্রতিনিধি হয়ে। বুঝাতে চাইছেন, ‘জাদুকর, অনেককিছুই তো করেছো, কিন্তু কটাতেই বা প্রথম হতে পেরেছে। এই রেকর্ডটাতে কিন্তু তোমার নামটাই প্রথম’। ছবিটাই ট্রেডমার্ক হয়ে আছে। এত বছর পর, আরও অনেক অনেক বছর পরও...
***
৯৯ সেঞ্চুরি। এক-দুই...নিরানব্বই। লিখতে গেলেও সময় দরকার কয়েক সেকেন্ড। ১৬ মার্চ, ২০১২ অবধি, এটা আপনার জাদুকরের সেঞ্চুরি সংখ্যা। তিনি বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলতে নেমেছেন, মিরপুরে। সবার কাছে হয়তো আর পাঁচটা ম্যাচের মতো। কিন্তু শচীনের কাছে অন্যরকম, ভিন্ন কিছু।
শচীন এক-পা দুই পা করে এগিয়ে যাচ্ছেন তার এবং বিশ্বের আকাঙ্ক্ষীত সেই দৃশ্যটার পথে। সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি! শচীন ৮০ পার হন, ডট বল খেলেন, গ্যালারি থেকে ভেসে আসে 'ভূয়া, ভূয়া' চিৎকার। শচীন কি কান বন্ধ করে থাকেন?
তিনি তার মাইলফলকের পথে ছুঁটেন একটু একটু করে। ১৩৪ তম বল শচীন যখন খেলছেন মিরপুরে, ঘড়ির কাটায় সময় তখন ৫ টা বেজে ৫ মিনিট। গোধূলির অপূর্ব দৃশ্যের চেয়ে কি শচীন আপনাকে টেনেছিল বেশি তার ব্যাটিং দেখতে?

শচীন কীর্তিটা করেই ফেললেন। সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি! এক বছর ধরে যেটা থেকে এক ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এরপর কেবল হেলমেটটা খুললেন, ব্যাটটা তুললেন। তাকালেন আকাশের দিকে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন বহু মানুষের জাদুকর? আপনি তখন কি করছিলেন? এত বছর পর এই ছবিটা দেখলেই কি আপনার সেই স্মৃতি মনে পড়ে?
***
এক ছবিতে কত গল্প বলা যায়? বিরাটের চেহারাটা এখনকার মতো রুক্ষ নয়, তারুণ্যের ছাপ স্পষ্ট তখন। ইরফান পাঠানের দাঁড়ি অবশ্য একই রকম। হরভজন এবারও আইপিএল খেলছেন, কিন্তু তার সে তেজস্বী ভাব নেই! গৌতম গম্ভীর অনেক আগেই ক্রিকেটটা ছেড়ে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন, যুবারাজও গেছেন অবসরে। ধোনি বিদায় বলেছেন ভারতের জার্সিকে।
একটা দেশের বিশ্বজয়। সবার একেকরকম গল্প। পাড়ার চা দোকানি থেকে দেশের অধিনায়ক পর্যন্ত। টঙ দোকানের চা ওয়ালা হয়তো ভেবেছেন, বিশ্বকাপটা জিতলে আমার কয়েক কাপ চা বেশি বিক্রি হবে। দেশের অধিনায়ক স্বপ্ন দেখেছেন ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরার।
তবে শচীনের গল্পটা আলাদা। অন্যরকম। ক্রিকেটাররা তার জন্য বিশ্বকাপ জিততে নামেন, বলে-কয়ে নামেন সেটা। তারা বিশ্বকাপটা জিততে চান আপনার জাদুকরের জন্য। বিরাট কোহলির ভাষায় যিনি ব্যাট দিয়ে একশ কোটি মানুষের দেশের ভার বয়েছেন অনেক বছর। আপনার জাদুকর আসলে ব্যাট হাতের সব রেকর্ড, মাইলফলকই নিজের করেছেন।

ক্রিকেট তাকে দিয়েছে দু হাত ভরে। একটা অপূর্ণতা হয়তো রেখে দিয়েছিল বিরাট কোহলি শচীনকে কাঁধে নিয়ে আছেন, এমন একটা ছবির অপেক্ষাতে। যে ছবিটা হাজার বছর ধরে চর্চা হবে ক্রিকেট ইতিহাসে। আপনার জাদুকরের ছবি, শচীনের বিশ্বকাপ জয়ের পরের এই ছবি...
***
ক্রিকেট, বিদায়।
শচীন কি এমন কিছু বলতে পারতেন সহজেই? পারতেন হয়তো। কিন্তু ২৪ বছরের সম্পর্কে কত কত ঋণ। তিনি একটা লম্বা লিস্ট করে নিয়ে এসেছেন তার পকেটে। তারও আগে ছুঁয়েছেন ওয়াংখেড়ের পিচ। আপনি এরপর দেখেছেন, কান্না পায় আপনার জাদুকরেরও!
ব্যাট হাতে ৭৪ রান করেছেন! তাতে কীইবা যায় আসে। ব্যাটিংয়ে নামার আগে আরেকটা মুহূর্ত ফ্রেমবন্দি হয়েছে কোনো এক ক্যামেরা ম্যানের ক্যামেরাতে। তিনি ছবিটা তুলছেন এমন- আপনার জাদুকর ওয়াংখেড়ের ড্রেসিং রুমের সিঁড়ি থেকে নেমে আসছেন মাঠে।

ওয়াংখেড়ের ওই দর্শকরা ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন আপনার বা তাদের জাদুকরকে। কিন্তু লোহার শেকল যেন হয়ে ওঠেছে চীনের মহাপ্রাচীর। তারা তাই মোবাইল ফোনের ক্যামেরা অন করে আছেন। জাদুকরকে আরেকবারের অথবা শেষবার মাঠে নামার এই দৃশ্যটাকে ধরে রাখতে।
মাঠে নামা, চিরকুট, দীর্ঘ বক্তব্য, ইনিংসে কত রান করলেন আর পিচ ছুঁয়ে সেই কান্না। সব কেমন এলেমেলো হয়ে যাচ্ছে। শচীনের বিদায়ী ম্যাচের এই ছবিটা দেখলে আপনার মন যেমন হয়ে যায়, তেমন?
***
পাঁচটা আলাদা গল্প। পাঁচটা আলাদা মাইলফলক। শচীন নামের জাদুকরের দেওয়া পাঁচটা আলাদা রকম আনন্দ। ছবিতে বন্দি হয়ে থাকা সময়, থমকে যাওয়া ছুটে চলা। জাদুকর বিদায় বলেছেন অনেক আগে, প্রায়ই কি ছবি আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় পুরোনো সেই সময়ে? মনে হয়, আরও একবার যদি দেখা যেত জাদুকরের জাদু, জটলা পাকিয়ে দেওয়া যেত হাততালি। অথবা বলা কিংবা শোনা যেত ‘শচীইইইন...শচীইইইইইইন’?
