ব্যাটার সাইফউদ্দিন দুর্ভাগা নাকি উপেক্ষিত!

‘বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই আমি হতে চেয়েছিলাম ব্যাটিং অলরাউন্ডার নিয়তি আমাকে বোলিং অলরাউন্ডার বানিয়ে দিল’—মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের আক্ষেপমাখা পোস্টটি নিয়ে ব্যাপক চর্চা হচ্ছে। চলমান বিপিএলে রংপুরের হয়ে শেষ দুই ম্যাচে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েই ঝলক দেখিয়েছেন টাইগার এই ক্রিকেটার। ১৪ বলে ২৩ রানের ইনিংসের পর সর্বশেষ ম্যাচে ৩১ বলে ৫২ রানে অপরাজিত ছিলেন। ম্যাচ দুটিতে তার দল জিততে না পারলেও সাইফের ক্যামিও ইনিংস ভক্তদের আক্ষেপ বাড়িয়ে দিয়েছে যেন।
সাইফের ব্যাট যখনই হাসে, টুকটাক আলোচনা হয়। অবশ্য আলোচনা হওয়ার মতো ব্যাটিংটা খুব একটা করার সুযোগই বা পেলেন আর কই! কমবেশি সবাই বলার চেষ্টা করে, সাইফ আসলে দুর্ভাগা। ভালো সামর্থ্য থাকা স্বত্ত্বেও সে তার ব্যাটিং সক্ষমতা দেখানোর সুযোগ পায় না।
ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে সাইফকে কখনোই দুর্ভাগা ভাবতে রাজি না। যেহেতু তার ব্যাটিং সক্ষমতা সম্পর্কে বেশ ভালো জানা আছে। যারা ব্যাটার সাইফকে দেখেছে, তারা সবাই এটা বিশ্বাস করতে চাইবে। সাইফের সাথে যা হয়, তা মূলত বাংলাদেশ ক্রিকেটের বেশ কয়েকটি বড় সমস্যার একটি। একটি সম্ভাবনাময় প্লেয়ারের শক্তির জায়গাটা নিয়ে কোচিং স্টাফদের গভীর পর্যালোচনা না করা, ছোট কিন্তু প্রভাব রাখা ইনিংস গুলোর গুরুত্ব অনুধাবণ করতে না পারা এবং কিছু ব্যাটারকে কেবলই নামের ওপর (চেহারা দেখে) বারংবার সুযোগ দেওয়ার বাজে চর্চাই এর প্রধান কারণ।

নয়তো সাইফ ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে ভালো করেননি, এমনটা খুবই কম ঘটেছে। তারপরও তার ব্যাটিং নিয়ে নতুনভাবে ভাবা হয়নি, তার ব্যাটিং অর্ডারে খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। না জাতীয় দলে, না ঘরোয়া ক্রিকেটে! টিম কম্বিনেশনের দোহাই দিয়ে তাকে নামতে হয় বারবার ব্যর্থ হওয়া ব্যাটারদের পরেই। একটা চিরাচরিত ব্যাটিং অর্ডার ভাঙতেই চাননি কর্তারা! ভাঙলেও তা নির্দিষ্ট ২-১ জনের জন্যই, সাইফের ভাগ্যে তা জোটে না।
কখন কীভাবে কারা সাইফকে বোলিং অলরাউন্ডার বানিয়ে দিয়েছে সেটা একটু পর্যালোচনা করলেই জানা যাবে। ক্যারিয়ারের শুরুতে সাইফ ছিল মূলত আস্থা রাখার মতো ব্যাটার, যে মাঠে থাকলে আপনি ভরসা করতে পারবেন। এলোমেলো শট খেলে আপনাকে ভীতিকর পরিস্থিতিতে রাখবে না, পর্যাপ্ত সময় পেলে স্কোরবোর্ডে চোখ রেখেই খেলতে অভ্যস্ত সে। বাড়তি হিসেবে ভালো ইকোনমিতে ম্যাচে ৪-৫ ওভার বোলিং করে দেয়া, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেকথ্রু এনে দিতে পারার পাশাপাশি ইয়র্কার করার দারুণ সক্ষমতা ছিল তার। কালক্রমে এটাকেই সাইফের মূল দক্ষতা ভাবা শুরু হলো, তাকে বানিয়ে ফেলা হলো স্লগ স্পেশালিষ্ট বোলার!
জোর করে বোলিং অলরাউন্ডার বানিয়ে তাকে গড়ে তোলা হলো ইনজুরি প্রবণ খেলোয়াড় হিসেবে। ইনজুরির প্রেক্ষাপটে সাইফকে কিছুটা দুর্ভাগা বলা যায়, যখনই সাইফ পারফর্ম করতে শুরু করেন, তখনই সে ছিটকে যায় ইনজুরিতে। এতেও দায় এড়াতে পারেন না সংশ্লিষ্টরা, তাকে নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা না থাকার কারণেই মূলত তার সময়-অসময়ে ইনজুরিতে পড়া। ফিট না থেকেও জোর করে প্রিমিয়ার লীগে খেলানো, স্লগ ওভারে ইয়র্কার দেওয়ার প্রেশার অন্যতম কারণ, যা প্রত্যেক নতুন প্লেয়ারের সাথেই হয়। তৈরি হওয়ার আগেই ফুরিয়ে যাওয়া।

অথচ এই সাইফের উঠে আসার ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল তার চমৎকার ব্যাটিং সক্ষমতা। তার বেসিক, শট সিলেকশন, পরিস্থিতি বুঝে ব্যাট চালানো, সবই পুরোদস্তুর ব্যাটারদেরই। স্কুল ক্রিকেট, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, স্থানীয় ক্রিকেট, সবক্ষেত্রে সেই ছিল দলের মূল ব্যাটিং শক্তি। প্রথম বিসিবির নজরেও এসেছিল বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে সে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েই। সে লেভেলে তার ধারাবাহিক ব্যাটিং পারফরম্যান্স সম্পর্কে বিসিবির বয়সভিত্তিক নির্বাচকরা ভালো জানেন। জেলা ও বিভাগীয় কোচরা তো জানেনই। ঘরোয়া টুর্নামেন্ট, যুব দল, এইচপি টিম, জাতীয় লীগ, ফ্রাইচাইজি টুর্নামেন্ট এবং জাতীয় দল, কোথাও সে নিয়মিত যুৎসই পজিশনে ব্যাট করার সুযোগ পায়নি। হুটহাট যখনই পেয়েছে, সেক্ষেত্রে সফলতার পরিমানই বেশি।
সংশ্লিষ্ট কোচিং স্টাফ, নির্বাচক এবং টিম ম্যানেজমেন্ট যদি গত ৫ বছরের বিপিএল, ডিপিএল ও জাতীয় দলে তার ব্যাটিং পরিসংখ্যান দেখার প্রয়োজন বোধ করেন, তবে তারাও নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন যে, ব্যাটার সাইফ আসলে দুর্ভাগা নয় মূলত তাকে সঠিক ব্যবহার করতে পারেননি তারা অথবা করেনি। তাকে বোলিং অলরাউন্ডার বানিয়ে রাখা যার অন্যতম কারণ। ২-৪ টি ম্যাচে সে স্লগে রান আটকে দিতে পারায় প্রায় সব ম্যাচেই তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে কঠিন মুহূর্তে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে কোনো পরিস্থিতিতেই নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটি তার সামর্থ্যের স্থানটিকে অগ্রাহ্য করে নয়।
অথচ এমন অনেক নাম আছে যাদেরকে দলে স্থায়ী করার জন্য নানা পজিশনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানো হয়েছে। তারা পারফরম্যান্স না করে বাদ গিয়েছে, আবার ফিরে এসেছে অন্যদের পারফরম্যান্স না করার বদৌলতে, নিজেরা পারফর্ম না করেই! সাইফের বেলায় বিষয়টি ভিন্ন। ইনজুরি অথবা পারফরম্যান্স, যে কারনেই বাদ গিয়েছে, সে ফিরেছে মোটা দাগের পারফর্ম করেই। এমন একজন লড়াকু ও প্রতিশ্রুতিশীল পুরোদস্তুর অলরাউন্ডারকে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে দলের পেস বোলাদের সাথে বিশেষ কিছু খেলোয়াড়কে সুযোগ সৃষ্টি করে দিতেই। স্লগে রান আটকাও, ইয়র্কার দাও নয়তো সেরা একাদশে জায়গা ছাড়ো। সাইফের মাথার ওপর এমনই একটা লক্ষ্য সীমা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিনিয়ত। কখনও সে সেগুলো উতরে গেছে, কখনও আটকে গেছে।

অথচ নিয়মিত (এক ম্যাচ দিয়ে দেখলাম,পরের ম্যাচে নামিয়ে দিলাম এমন না) সুযোগ দিলে একদিনের ম্যাচে সাইফ হতে পারতো দেশের অন্যতম সেরা একজন মিডল অর্ডার ব্যাটার, যে প্রয়োজন বোধে দলের হাল ধরবে এবং ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী ম্যাচ শেষ করবে। কিন্তু শেষ সময়ে নামিয়ে তাকে মূলত পিঞ্চ হিটার বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে প্রায়শই। সেটাও সে ‘কমবেশী’ করেছে যদিও! একদিনের ক্রিকেট কিংবা টি-টোয়েন্টি, তাকে যদি মিডলঅর্ডারে নিয়মিত সুযোগ দেওয়া হয়, তবে সে ভালো করবেই এটা আমার বিশ্বাস।
লেখক :
শরিফুল ইসলাম অপু
ক্রীড়া লেখক ও সংগঠক
সার্টিফাইড আম্পায়ার, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।