ক্রীড়া সংগঠক সভাপতি, সেক্রেটারি পদে ফিরলেন ২ জন

গত বছরের ১৪ নভেম্বর নয়টি ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা করেছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। আড়াই মাস পর আজ (মঙ্গলবার) আরও সাতটি ফেডারেশনের কমিটি প্রকাশ করা হয়েছে। এই কমিটি নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে চলছে নানা বিশ্লেষণ ও আলোচনা।
১২৭ জনের মধ্যে ৬০ জন সাবেক খেলোয়াড়
ভারত্তোলন, টেবিল টেনিস ও শরীর গঠনের কমিটি ১৭ জন করে। সাঁতার, ভলিবল, ফেন্সিং ও কারাতের কমিটিতে রয়েছেন ১৯ জন করে। সাত কমিটিতে রয়েছেন মোট ১২৭ জন। এর মধ্যে ৬০ জনই সাবেক খেলোয়াড়। ফুটবল-ক্রিকেট ছাড়া দেশের অন্য সকল খেলা সার্ভিসেস সংস্থা নির্ভর। আজ ঘোষিত প্রায় সকল ফেডারেশনেই সেনা, নৌ, আনসার, বিমান, বিকেএসপি থেকে সংশ্লিষ্ট খেলার প্রতিনিধি মনোনয়ন দিতে বলা হয়েছে। সেসব সংস্থায় সংশ্লিষ্ট খেলা নিয়ে কাজ করেন অনেক সাবেক খেলোয়াড়। ফলে কমিটিগুলোতে অন্তত ১০-১২ জন আরও সাবেক খেলোয়াড় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৪ নভেম্বর ঘোষিত নয়টি ফেডারেশনের কমিটিতে ব্যবসায়ী-পৃষ্ঠপোষকদের প্রাধান্য ছিল।
ফেডারেশন কমিটির নির্বাচনে সাবেক খেলোয়াড়রা আসার সুযোগ পান না। কারণ নির্বাচন করতে কাউন্সিলর হতে হয়। খেলোয়াড়দের পক্ষে অনেক সময় ক্লাব/ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলরশিপ যোগাড় করাও সম্ভব হয় না। অ্যাডহক কমিটিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ যে কাউকে যোগ্য/প্রয়োজন মনে করলে মনোনয়ন করতে পারে। সাবেক খেলোয়াড়রা ফেডারেশনে সুযোগ পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট খেলা এগিয়ে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা।
উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব সাঁতারে সদস্য
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বিভিন্ন ফেডারেশনের কমিটিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তা/কর্মচারী ছিল। সবাইকে এক অফিস আদেশের মাধ্যমে সেই সকল কমিটি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।
আজ ঘোষিত সাঁতার ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটিতে রয়েছেন উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। উপদেষ্টার একান্ত সচিব ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন একটি ফেডারেশনে থাকলে ওই ফেডারেশন বাড়তি প্রাধান্য বা গুরুত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিগত সময়েও ক্রীড়াঙ্গনে এই সমস্যা ছিল। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব রশিদুজ্জামান সেরনিয়াবাত একাধিক ফেডারেশনে ছিলেন। ফেডারেশনের কর্মকর্তা হয়ে অনেক বিদেশ সফরও করেছেন তিনি। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা হওয়ার পর সেরনিয়াবাতকে এনএসসি’র একান্ত সচিব থেকে সরিয়ে বান্দরবান স্টেডিয়ামের প্রশাসক করেছেন।
সার্চ কমিটির সুপারিশ রদবদল তুলনামূলক কম
ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের জন্য ২৯ আগস্ট সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছিল। সেই কমিটি ফুটবল-ক্রিকেট বাদে অন্য সকল ফেডারেশনগুলোর কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে অ্যাডহক কমিটির তালিকা সুপারিশ করে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়/এনএসসি কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় রদবদল করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার রাখে। সেই আলোকে ১৪ নভেম্বর প্রথম ধাপে ঘোষিত ৯ ফেডারেশনের কমিটিতে সুপারিশের সঙ্গে ঘোষিত কমিটিতে কয়েকটি রদবদল ছিল। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন ছাড়া অর্ন্তভুক্ত ছিল অন্য পদেও। আজ ঘোষিত সাত ফেডারেশনের কমিটিতে অবশ্য সুপারিশ থেকে কয়েকটি রদবদল হয়েছে বলে জানা গেছে বিশ্বস্ত সূত্রে। তবে সেই সংখ্যা আগের তুলনায় কম। এক সূত্রের খবর, সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত কোনো সভাপতিই বদল হয়নি। আজ ঘোষিত সাত কমিটি নিয়ে সার্চ কমিটির আহবায়ক জোবায়েদুর রহমান রানার সামগ্রিক মন্তব্য, ‘বেশ কয়েকটি ফেডারেশনে পুরোনো মুখ ফিরেছে। সেটা স্বাভাবিকও। যারা কমিটিতে আছেন তারা যোগ্য এবং সামনে স্ব স্ব খেলার অগ্রগতির জন্য কাজ করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
আরও পড়ুন
সভাপতি পদে সাবেক দুই সেক্রেটারি
ভারত্তোলন ও উইং কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ (অব.) সমার্থক শব্দ। মহিউদ্দিন ভারত্তোলন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন চার দশক। গত কয়েক বছর ধরে সহ-সভাপতি আছেন তিনি। ফেডারেশন ছাড়াও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বিমান বাহিনীর ক্রীড়াসহ ক্রীড়াঙ্গনের প্রায় সকল স্তরে কাজ করেছেন। এরপরও তিনি কখনও ফেডারেশনের সভাপতি মনোনীত হতে পারেননি।
আজ ভারত্তোলন ফেডারেশনের সভাপতি মনোনীত হয়ে মহিউদ্দিনের প্রতিক্রিয়া, ‘৫৩ বছর আমি ক্রীড়াঙ্গনে। অবশেষে সরকার আমাকে সভাপতি মনোনীত করল। ক্রীড়াঙ্গনে যোগ্য কেউ থাকলে অবশ্যই তাকে সভাপতি পদ দেওয়া উচিৎ। সভাপতি হওয়ায় এখন দায়িত্ব আরও বেড়েছে।’
ফেন্সিং ফেডারেশনে সভাপতি হয়েছেন কামরুল ইসলাম। বাংলাদেশে ফেন্সিং খেলার অন্যতম প্রবর্তক তিনি। দীর্ঘদিন এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে সাধারণ সম্পাদক থেকে সরিয়ে সহ-সভাপতি করা হয়। এরপর এসোসিয়েশন থেকে ফেডারেশনে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নির্বাচিত কমিটি হয়। এখন আবার অ্যাডহক কমিটিতে কামরুল ইসলামকে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হলো। তিনিও সভাপতি হলেন ক্রীড়া সংগঠকদের মধ্যে থেকে।
ফুটবল-ক্রিকেট বাদে অন্য সকল ফেডারেশনের সভাপতি সরকার থেকে মনোনীত হয়। ফেডারেশনের সর্বোচ্চ পদে সরকার দলীয় এমপি, মন্ত্রী বা ব্যবসায়ীরা বিগত সময়গুলোতে অধিষ্ঠিত হয়ে আসছে। অনেক যোগ্য সাবেক ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক থাকলেও তারা কখনও ফেডারেশনের পদে আসীন হতে পারেন না। দুই-একজন সাবেক ক্রীড়াবিদ-সংগঠক ফেডারেশন/এসোসিয়েশনের সভাপতি হলেও তারা পরবর্তীতে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। খেলোয়াড়-সংগঠকের পরিচয়ের চেয়ে রাজনীতি/ব্যবসায়ী পরিচয় গুরুত্ব পাওয়ায় মূলত তারা সভাপতি মনোনীত হন।
সাধারণ সম্পাদক পদে ফিরলেন শাহীন ও সেন্টু
মাহবুবুর রহমান শাহীন ও মোয়াজ্জেম হোসেন সেন্টু সাঁতার এবং কারাতে ফেডারেশনে সাধারণ সম্পাদক পদে ফিরেছেন। সেন্টু সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। এক যুগ সাঁতারের কমিটিতে ছিলেন শাহীন। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে শাহীন ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। ক্লাব ও ফেডারেশন দুই দায়িত্ব পালন নিয়ে শাহীনের মন্তব্য, ‘আমাদের ক্লাবে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি আলাদা সাব-কমিটি রয়েছে। তারা স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে। সেক্রেটারি হিসেবে আমি সমন্বয় করি। এর আগেও যখন সাঁতার ফেডারেশনে সেক্রেটারি ছিলাম, তখন বাফুফে এবং অলিম্পিকেও ছিলাম, সমস্যা হয়নি। আশা করি এখনও হবে না।’
ভলিবলে মিকু অধ্যায়ের সমাপ্তি
প্রায় দুই যুগ ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান মিকু। নড়াইল থেকে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া সংগঠকে পরিণত করেছেন। অন্য ফেডারেশনের নির্বাচনে জেলা-বিভাগীয় স্বার্থে হস্তক্ষেপের জন্য সমালোচিত ছিলেন তিনি। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ভলিবলে থাকলেও তেমন দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন ছিল (সর্বশেষ ৩-৪ বছর ছাড়া) না। আজ অ্যাডহকের মাধ্যমে মিকু অনেকদিন পর ফেডারেশনের বাইরে।
ভলিবলে মিকুর স্থলাষিভিক্ত হয়েছেন এই ইভেন্টের সাবেক খেলোয়াড় বিমল ঘোষ ভুলু। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত তিনি ভলিবল খেলেছেন। আকস্মিক এই দায়িত্ব পেয়ে তার মন্তব্য, ‘কমিটিতে যারা আছেন সবাই ভলিবল অনুরাগী। সবাইকে নিয়ে ভলিবলকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব।’
‘অচেনা’ সাধারণ সম্পাদক
ফেডারেশনের সর্বোচ্চ পদ সভাপতি হলেও সাধারণ সম্পাদকই মূলত প্রধান নির্বাহী। তাই ফেডারেশনের সাফল্য-ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে সাধারণ সম্পাদকের ওপরই। ফেন্সিংয়ে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে বসুনিয়া এম আশিকুল ইসলামকে। তার পরিচিতি হিসেবে লেখা রয়েছে পৃষ্ঠপোষক এবং এই খেলায় আগ্রহী।
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা টেবিল টেনিস (টিটি)। সেই টিটির সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে সাবেক খেলোয়াড় এএম মাকসুদ আহমেদকে (সনেট)। এতে টিটি অঙ্গনে খানিকটা বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। কারণ তার অধীনে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে আছেন দেশের টিটির অন্যতম সেরা খেলোয়াড় নাসিমুল হাসান কচি। আরেক সাবেক তারকা সাইদুল হক সাদী বিগত কমিটি থাকলেও এই কমিটিতেই নেই।
এজেড/এএইচএস