বাফুফে কর্তাদের বেফাঁস মন্তব্য, ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ কোথায়?

জাতীয় দলের স্প্যানিশ কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরার সমালোচনায় প্রায় পুরো ফুটবলাঙ্গন। সাবেক ফুটবলার, সংগঠক, সমর্থক সবার কাঠগড়ায় ক্যাবরেরা। গতকাল বাফুফের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বাফুফে নির্বাহী সদস্য ও জাতীয় দল কমিটির সদস্য সাখওয়াত হোসেন ভূইয়া শাহীন প্রকাশ্যে ক্যাবরেরার পদত্যাগ দাবি করেছেন।
সাখওয়াত হোসেন ভূইয়া শাহীনের মতামতের সঙ্গে দেশের ফুটবলাঙ্গনের প্রায় সবাই একমতই পোষণ করেছেন। তিন বছরের বেশি সময় ক্যাবরেরা বাংলাদেশ দলের কোচ থাকলেও তেমন কোনো সাফল্য নেই। দল নির্বাচন, ম্যাচ কৌশল আগেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এখন হামজা-সামিতের মতো ফুটবলার বাংলাদেশ দলে আসার পরও সেটার সদ্ব্যবহার করতে পারছেন না।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সাখওয়াত হোসেন ভূইয়া শাহীনের কোচের পদত্যাগ চাওয়ার যৌক্তিকতা থাকলেও বাফুফে নির্বাহী সদস্য হিসেবে প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য প্রদান নিয়েও চলছে আলোচনা। কোচ নিয়ে তার মতামত, পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট কমিটির সভায় অথবা সভাপতিকে আলাদাভাবে বলার সুযোগ ছিল। সেটা না করে তিনি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগ দাবি করায় বাফুফে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যেই পড়েছে। এতে উঠে এসেছে বাফুফে কর্মকর্তাদের কোড অব কন্ডাক্ট প্রয়োগের বিষয়টি।
২০২৪ সালের ২৬ অক্টোবর বাফুফে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাত মাস পেরিয়ে গেলেও নির্বাহী কমিটির সদস্যদের অনেকেই এখনো কোড অব কন্ডাক্ট নিয়ে অবগত নন। প্রায় দুই দশক পর আবার ফেডারেশনের কমিটিতে এসেছেন সাবেক জাতীয় ফুটবলার ছাইদ হাসান কানন। তিনি কোড অব কন্ডাক্ট নিয়ে বলেন, 'যতটুকু মনে পড়ে কোড অব কন্ডাক্ট সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আমি কোনো স্বাক্ষর করিনি। নির্বাহী কমিটির জন্য কোড অব কন্ডাক্ট লিখিত কোনো নির্দেশনাও আমি পাইনি।'
এবার বাফুফে নির্বাচনে প্রথমবারের মতো কমিটিতে এসেছেন আরো কয়েকজন। তাদের অনেকেই কোড অব কন্ডাক্টের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত নন। বর্তমান কমিটির কয়েকজন রয়েছেন যারা বিগত সময়েও কমিটিতে ছিলেন। তাদের দুই জনের মতে, '২০১৩ সালে একটি কোড অব কন্ডাক্ট পাশ হয়েছিল। এরপর ২০২০ সালের নির্বাচনের পর তখন কমিটির সবাইকে একটি কোড অব কন্ডাক্টে স্বাক্ষর করানো হয়েছিল। এবার প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সভায় কোড অব কন্ডাক্ট নিয়ে মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হলেও কোনো স্বাক্ষর নেয়া হয়নি কিংবা লিখিত কিছুও দেয়া হয়নি।'
বাফুফে এবার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে মনোনীত সদস্যদের একটি ফরম ও নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা গেছে। সেখানেও আচরণ বিধি সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। বাফুফে নির্বাহী কমিটির সকল সদস্যই কোনো না কোনো স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য কিংবা চেয়ারম্যান। ফলে তারা কোড অব কন্ডাক্টের আওতায়ই রয়েছেন বলে পর্যবেক্ষণ এক সদস্যের।
২০১৩ সালে বাফুফে নির্বাহী কমিটি সহ তাদের অধীভুক্ত সকল অংশীদারদের জন্য কোড অব কন্ডাক্ট প্রণয়ন করে। সেই কোড অব কন্ডাক্টে নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তাদের জন্যও দু’টি পয়েন্টে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। তন্মেধ্যে উল্লেখযোগ্য, 'দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বা ফুটবল তথা বাফুফের স্বার্থবিরোধী কোনো ঘটনার উদ্ভব হলে তাহা কার্যনির্বাহী কমিটিতে আলোচনা বা সভাপতির দৃষ্টিগোচর আনতে হবে। এ সকল ক্ষেত্রে ‘বাফুফে’র বাহিরে বা ভেতরে গোপনে বা প্রকাশ্যে, সংবাদ মাধ্যমে বা মিডিয়াতে কখনও কোনো মন্তব্য বা বিবৃতি বা সমালোচনা করা যাবে না।’ আরেকটি পয়েন্টে রয়েছে, 'প্রস্তাব বা সুপারিশ অনুমোদের পূর্ব পর্যন্ত প্রস্তাবের বা সুপারিশের গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে। প্রস্তাব বা সুপারিশ সভাপতি কর্তৃক বা কার্য নির্বাহী কমিটি কর্তৃক যে ভাবেই অনুমোদিত হোক না কেন ইহার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বা গোপনে কোন মন্তব্য বা সমালোচনা করা যাবে না।'

তাবিথ আউয়ালের নতুন কমিটির সাত মাসের মধ্যে তিন জন নির্বাহী সদদ্যের মন্তব্য কোড অব কন্ডাক্ট ভঙ্গের পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাফুফে জরুরি কমিটির সভার মাধ্যমে বৃটিশ কোচ পিটার বাটলার ও স্পেনিশ কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরাকে যথাক্রমে নারী ও পুরুষ ফুটবল দলের হেড কোচের দায়িত্ব নবায়ন করে। সিনিয়র নারী ফুটবলাররা বাটলার নিয়ে আন্দোলনের এক পর্যায়ে নারী ফুটবল উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণ গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘বাফুফের হায়ার অথরিটিকে আমি জানিয়েছি, কোচের সঙ্গে মেয়েদের কি সমস্যা। এই কোচকে যেন নিয়োগ না দেয়া হয়, সেটাও বলেছি। কোচ নিয়োগ দেয়া হয়েছে, ইর্মাজেন্সি কমিটির মাধ্যমে। এই কমিটিতে আছে বাফুফের চার সহ সভাপতি, সিনিয়র সহ সভাপতি ও সভাপতি। তারা মনে করেছেন, বাটলার ভালো কোচ।'
কিরণের এমন মন্তব্য গোপীনয়তা ভঙ্গেরও শামিল পাশাপাশি পরোক্ষভাবে বাফুফের সিদ্ধান্তের সমালোচনা। কিরণের এমন মন্তব্যের দুই মাস পর বাফুফের আরেক নির্বাহী সদস্য টিপু সুলতান রেফারিং নিয়ে বেফাস কথা বলেছেন এক গণমাধ্যমে। ফেডারেশন কাপের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে কিংস ও রহমতগঞ্জের ম্যাচ রেফারি ছিনতাই করেছেন এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। টিপু সুলতান পুরান ঢাকার ক্লাব রহমতগঞ্জের সভাপতি হলেও বাফুফে নির্বাহী সদস্য হিসেবে রেফারিং নিয়ে এমন মন্তব্য স্পষ্টত কোড অব কন্ডাক্ট বর্হিভূত। এটি যেখানে সমালোচিত হওয়ার কথা সেখানে উল্টো রহমতগঞ্জ ক্লাব ফেডারেশন কাপের ফেয়ার প্লে ট্রফি পেয়েছে। অথচ ২০২১ সালে বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ও তৎকালীন ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ইমরুল হাসান ফেডারেশন কাপের ফরম্যাট ও কিছু বিষয়ে গণমাধ্যমে মন্তব্য করায় বাফুফে তখন তাকে শোকজ করেছিল। ২০২০-২৪ মেয়াদে নির্বাহী কমিটির আরো দুই জন কর্মকর্তা শোকজ ও সতর্কবাতা পেয়েছিলেন।
নতুন কমিটির দুই সদস্য কিরণ ও টিপু তাদের এমন মন্তব্যের জন্য কোনো কাঠগড়া কিংবা আভ্যন্তরীণ কোনো সমালোচনায় পড়তে হয়েছে বলে জানা যায়নি। বিগত ঘটনাগুলোর কোনো দৃষ্টান্ত না থাকায় গতকাল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় দল ও নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েও কোচের পদত্যাগ দাবি চাওয়ার মতো মন্তব্য এসেছে। এই তিনটি মন্তব্য বড় আকারে চোখে পড়লেও ছোট-খাটো অনেক কিছুই সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে যা আচরণ বিধির প্রশ্নের মুখে পড়ে। সভায় আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের আগেই দুই-এক জন কর্মকর্তা গণমাধ্যমে সিদ্ধান্ত/ভাবনা ব্যক্ত করেন। যদিও গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল এই সব বিষয় উত্তরণের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
২০১৩ সালের কোড অব কন্ডাক্টের পর আর কোনো কোড অব কন্ডাক্ট হয়েছে কি না এই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যায়নি। নির্বাহী কমিটির একাধিক ব্যক্তি পরবর্তীতে আপডেটের কথা বললেও সেটার কোনো কপি কিংবা ফাইল পাওয়া যায়নি। বাফুফে নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তাদের জন্য সর্বশেষ কোড অব কন্ডাক্ট কোনটা প্রযোজ্য নাকি আদৌ নেই-ই এই সংক্রান্ত বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এজেড/এইচজেএস