রাজিন-কাপালির পর জাতীয় ক্রিকেটে নেই সিলেটি ব্যাটার, উত্তরণের উপায় কী

দুটি কুড়ি একটি পাতার শহর সিলেট। চা বাগান আর পাহাড়ি সৌন্দর্যে অপরূপ এই নগর শুধু পর্যটনেই নয়, দেশের ক্রিকেট মানচিত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রেখেছে। এখান থেকেই বাংলাদেশ পেয়েছে অলক কাপালি ও রাজিন সালেহদের মতো ক্রিকেটার। অলক কাপালি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে হ্যাটট্রিক করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছিলেন। অন্যদিকে রাজিন সালেহ নেতৃত্বগুণ ও ব্যাটিং দৃঢ়তায় জায়গা করে নেন জাতীয় দলে।
তবে সেসব সাফল্যের ঝলক ফিকে হয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে। সিলেটের মাঠ এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজন করে চলেছে সুনামের সঙ্গে। এমনকি বিপিএলেও সিলেটের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। তবুও প্রশ্ন রয়ে গেছে– কেন নতুন প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য ব্যাটার জাতীয় দলে জায়গা নিতে পারছেন না? গেল এক যুগে জাতীয় দলে খেলেছেন কেবল জাকির হাসান এবং জাকের আলি অনিক।
স্থানীয় কোচদের মতে, সিলেটের পিচ ও কন্ডিশন বোলারদের অনুকূলে। রান করা কঠিন হওয়ায় বড় ইনিংস খেলার অভ্যাস গড়ে ওঠে না তরুণদের মধ্যে। এর সঙ্গে ঢাকাকেন্দ্রিক লিগ ব্যবস্থা আর নির্বাচনী প্রক্রিয়া মিলে সিলেটের ব্যাটাররা জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়তে পারছেন না।
বর্তমানে সিলেটের মাটিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডসের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। যেখানে খেলছেন কেবল একজন সিলেটি ব্যাটার জাকের। দুই জাকের-জাকিরই আবার জাতীয় দলে এসেছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) থেকে। সিলেট বিভাগ থেকে লম্বা সময় ধরে ব্যাটসম্যান উঠে না আসার কারণ জানতে স্থানীয় ম্যানেজার ও সাবেক তারকাদের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট।
সিলেটের বিভাগীয় ক্রিকেট দলের ম্যানেজার আলী ওয়াসিকুজ্জামান অনি বলেন, ‘এটা আসলে সত্যি যে রাজিন সালেহ এবং অলক কাপালির পরে সিলেট থেকে আর কোনো ব্যাটসম্যান আসেনি। এ ছাড়া জাকির হাসান এবং জাকের আলিদের উত্থান কিন্তু বিকেএসপি থেকে হয়েছে। তারা সিলেটের ছেলে, কিন্তু এখান থেকে সেভাবে সুযোগ-সুবিধা পায়নি।’
এর পেছনে সিলেট বাদে আশপাশের জেলায় দীর্ঘ সময় লিগ না হওয়াকেও দায়ী করেছেন অনি, ‘আরেকটা জিনিস আপনাকে বলে রাখি সিলেটের চারটা জেলার ভেতর শুধু সদরে লিগ হয়। এ ছাড়া সুনামগঞ্জে বা অন্য জায়গায় টুর্নামেন্ট হয় না। মৌলভীবাজারে ১২ বছর ধরে লিগ বন্ধ। প্রতিযোগিতামূলক খেলা না হলে তো আসলে ব্যাটসম্যান পাওয়া কঠিন।’
সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমান সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য রাহাত শামসের মতে, ‘দেশীয় বোলাররা কিন্তু অনেকটা ন্যাচারালি উঠে আসে। জোরে বল করার একটা ব্যাপার আছে, যখন সেটা ন্যাচারাল পাওয়া যায়, তখন সেটাকে ফাইন টিউন করা যায়। আর ব্যাটিংয়ের স্কিলটা কিন্তু ন্যাচারালি হয়ে উঠে না। অনেক বেশি টেকনিক এবং প্র্যাকটিসের ব্যাপার আছে।’
সমাধান কী হতে পারে সেটিও জানালেন রাহাত শামস, ‘জোরে বল করতে পারা আর সুন্দর বেসিকে ব্যাটিং করা এক না। দুইটার মধ্যে তফাৎ আছে। আমাদের উন্নতির পথ হচ্ছে– একেবারে রুট লেভেল থেকে ক্রিকেটার তুলতে হবে। এজন্য যত বেশি ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করা যায়। জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক যে কোচরা আছেন, তাদের হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। তাদের ম্যানপাওয়ার শক্তিশালী করতে হবে, সাপোর্ট দিতে হবে। তা না হলে ব্যাটসম্যান তুলে আনাটা খুব কঠিন।’
রাজিন সালেহ’র মতে, ‘প্রথম বিভাগে একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। আমার দশটা খেলোয়াড়, আর আমার পাঁচটা খেলোয়াড় এরকম করে করে আসলে শেষ হয়ে যায়। অনেক ট্যালেন্ট প্লেয়ার যারা সেকেন্ড ডিভিশন খেলে, এদেরকে সুযোগ দেওয়া হয় না। তারা সুযোগ না পাওয়ার কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে আমাদের ক্রিকেট।’
সাবেক অধিনায়ক রাজিন সালেহ বর্তমানে বিসিবির কোচ। তিনি জানিয়েছেন, ‘ঘাটতিটা হলো ঘরোয়া লিগ না হওয়া। ঘরোয়া লিগ যদি হয়, সেটা সুন্দরভাবে আয়োজন করতে হবে। কোনো রকম গা বাঁচানো লিগ যাতে না হয়। যারা জাতীয় পর্যায়ে গেছে তারা মূলত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেই উঠেছে। ঠিক করতে হবে জেলাভিত্তিক খেলাটা। খেলোয়াড় নির্বাচনটা যদি একটু ফেয়ার হয়…গত বছর নাজমুল ছিল ভালো সিলেকশন। এই প্রক্রিয়াটা যদি সঠিক হয়, তাহলে খেলোয়াড় পাওয়া কিন্তু সহজ। আমি বলছি না যে কোচরা আনফেয়ার করতেছে। প্রতিভাবান খেলোয়াড় দেখার জন্য আসল চোখ লাগবে।’
আরও পড়ুন
রাজিনের অভিযোগ– ‘অনেক সময় সিলেকশন হয় যে আমার একাডেমি–তোমার একাডেমি, এই করতে করতে কিন্তু দেশটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা দেশের চিন্তা করি, তাহলে সিলেকশনে কিন্তু সমস্যা হওয়ার কথা না। এমনকি অনেক ক্রিকেটার রয়েছে যারা প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ না হওয়ায় এবং ভালো চোখ না থাকার কারণে সুযোগ পাচ্ছে না। আমাদের অনেক ভালো ব্যাটসম্যান রয়েছে, যারা ঢাকায় প্রথম বিভাগ খেলার সুযোগ পায় না।’
সিন্ডিকেট বা ক্রিকেটীয় চক্রের কারণে প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা যথেষ্ট সুযোগ পায় না বলে মনে করেন সাবেক এই অধিনায়ক, ‘এটা সত্যি যে প্রথম বিভাগে একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। আমার দশটা খেলোয়াড়, আর আমার পাঁচটা খেলোয়াড় এরকম করে করে আসলে শেষ হয়ে যায়। অনেক ট্যালেন্ট প্লেয়ার যারা সেকেন্ড ডিভিশন খেলে, এদেরকে সুযোগ দেওয়া হয় না। তারা সুযোগ না পাওয়ার কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে আমাদের ক্রিকেট।’
বিকেএসপি থেকে আসা জাতীয় দলের সিলেটি ক্রিকেটার জাকির হাসান বলেন, ‘আগের কথাই বলি আমাদের সিলেটে যে একাডেমিগুলো ছিল অনুশীলনের জন্য, সেখানে যে সুযোগ-সুবিধা ছিল কোচিংয়ের, সেটা যে একদম সর্বোচ্চ লেভেলের তা বলব না। এখন যদি আপনি বলেন যে রাজিন ভাই হয়তো মনিটরিং করে অনেক। ব্যাটিংয়ের জন্য শুধু রাজিন ভাই আছে, আশা করি সামনে হয়তো আরও বাড়বে। সবমিলিয়ে সুযোগ-সুবিধা কম মনে হয় আমার। দক্ষ বোলার বের হওয়া সহজ। যারা জোরে বল করে, তাদের ঘষামাজা করে ঠিক করতে পারবেন।’
‘কিন্তু একজন ব্যাটসম্যান বানাতে হলে তার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। তারপর একজন ব্যাটসম্যানের দক্ষতা ও সামর্থ্য হয়, এ ছাড়া সম্ভব না। আপনি যেকোনো জায়গায় প্র্যাকটিস করলেন আর ব্যাটসম্যান হয়ে গেলেন এটা আসলে হয় না। সেটা মাঝেমধ্যে হতে পারে, সব সময় না। এর জন্য ভালো ফ্যাসিলিটি ও তদারকি দরকার’, মনে করেন বাঁ-হাতি ব্যাটার জাকির।
অদূর ভবিষ্যতে সিলেট থেকে জাতীয় দলে ব্যাটার যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভালো কোচের প্রয়োজন দেখছেন জাকির, ‘রাজিন ভাই কোচ হিসেবে আছেন, আবার বিসিবির অধীনে কোচিং করাচ্ছেন যেহেতু স্থানীয় ক্রিকেটে পুরো সময় দিতে পারছেন না। তবে আমাদের সিলেট বিভাগে কয়েকজন ভালো ব্যাটার আছে ভবিষ্যতের জন্য। তারা নিজে থেকে চেষ্টা করছে, এরসঙ্গে যদি ভালো কোচ থাকেন, তাহলে আশা করি চার পাঁচ বছরের ভেতর জাতীয় দলে আসবে।’
সীমাবদ্ধতা ও সংকট থাকলেও আশার আলো নেভেনি। সিলেটের ক্রিকেটসংশ্লিষ্টদের মতে সেখানে ক্রিকেট সংস্কৃতির শেকড় বেশ গভীর, গ্যালারিতে দর্শকদের প্রবল আগ্রহ দেখা যায়। সঠিক অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা পেলে অলক-রাজিনের উত্তরসূরি হয়ে সিলেট থেকে আবারও জাতীয় পর্যায়ে নতুন ব্যাটার দেখা যেতে পারে বলে সবার প্রত্যাশা!
এসএইচ/এএইচএস
