খেলোয়াড়দের মধ্যে কেন হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি বেশি?

খেলা-ধূলা মানেই দ্রুততা, গতি আর বিস্ফোরণশক্তি। কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক সাধারণ, তবুও ভয়ঙ্কর ইনজুরি হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেইন। আমি একজন স্পোর্টস ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে দেখেছি হকি, ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড প্রায় সব খেলাতেই এই ইনজুরির প্রবণতা। প্রশ্ন হলো, কেন বারবার এই ইনজুরিতে পড়েন খেলোয়াড়রা?
হ্যামস্ট্রিং মাংসপেশির কাজ কী?
হ্যামস্ট্রিং মূলত উরুর পিছনের তিনটি পেশি—Biceps Femoris, Semitendinosus, এবং Semimembranosus। এই পেশিগুলো একসঙ্গে কাজ করে হাঁটু ভাঁজ করা ও হিপ জয়েন্টকে প্রসারিত করতে। তবে স্প্রিন্টিং, জাম্পিং বা হঠাৎ দিক পরিবর্তনের সময় এই পেশিগুলো সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে পড়ে।
হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির মূল কারণসমূহ
১. হাই-স্পিড দৌড়ঝাঁপ বা স্প্রিন্টিং
দৌড়ের সময় “টার্মিনাল সুইং ফেজ”-এ হ্যামস্ট্রিং মাংসপেশি লম্বা হয়ে সংকুচিত হয় — যাকে বলে Eccentric Contraction। এই সময়ই চোটের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। Timmins et al., BJSM (2021): স্প্রিন্টিংয়ের সময় ইসেন্ট্রিক ওভারলোডই হামস্ট্রিং ইনজুরির প্রধান কারণ।
২. পেশির ভারসাম্যহীনতা
যদি Quadriceps (সামনের উরু) শক্তিশালী হয় কিন্তু Hamstring (পেছনের উরু) দুর্বল থাকে, তাহলে H/Q ratio বিঘ্নিত হয়। ফলে দৌড় বা কিক মারার সময় হ্যামস্ট্রিংকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়, যা টান ও ছেঁড়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
৩. অতিরিক্ত অনুশীলন ও ক্লান্তি
যখন খেলোয়াড় ক্লান্ত থাকে, পেশি ঠিকভাবে শক শোষণ করতে পারে না। ফলে হঠাৎ গতিবিধির সময় মাইক্রো-টিয়ার হয়। Greig et al., 2022: ক্লান্ত অবস্থায় স্প্রিন্টিংয়ের বায়োমেকানিক্স পরিবর্তিত হয়ে হামস্ট্রিংয়ে অতিরিক্ত স্ট্রেস তৈরি করে।
৪. পর্যাপ্ত ওয়ার্ম-আপ ও ফ্লেক্সিবিলিটির অভাব
ঠান্ডা বা শক্ত মাংসপেশি সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে। সঠিক ডাইনামিক ওয়ার্ম-আপ, মোবিলিটি ও ফ্লেক্সিবিলিটি ট্রেনিং ইনজুরির ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়।
৫. পূর্বের ইনজুরি ইতিহাস
আগে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি হয়ে থাকলে আবার চোট পাওয়ার ঝুঁকি ২–৬ গুণ বেশি। অসম্পূর্ণ রিহ্যাব বা স্কার টিস্যু পেশির স্বাভাবিক ইলাস্টিসিটি কমিয়ে দেয়। ফলে দৌড়ের সময় টান পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
৬. দৌড়ানোর ভুল কৌশল
ভুল ভঙ্গিতে দৌড়ালে হ্যামস্ট্রিংয়ের উপর বাড়তি চাপ পড়ে। যেমন—সামনে ঝুঁকে দৌড়ানো, Anterior pelvic tilt (পেলভিস সামনের দিকে হেলে থাকা), ওভারস্ট্রাইডিং ইত্যাদি কারণ। এসব বায়োমেকানিক্যাল সমস্যা অনেক সময়ই ইনজুরির মূলে থাকে।
৭. হ্যামস্ট্রিংয়ের নিজস্ব গঠন
Biceps Femoris (long head) দুইটি জয়েন্ট অতিক্রম করে (hip ও knee), ফলে এটি সবচেয়ে বেশি টান খায়। তাই এই অংশে ইনজুরির হার অন্য পেশির তুলনায় বেশি।
গবেষণায় যা বলা হয়েছে
van Dyk et al., BJSM (2020): নিয়মিত Nordic Hamstring Exercise করলে ইনজুরির ঝুঁকি ৫১% পর্যন্ত কমে।
Askling et al., 2021: ধীর ও নিয়ন্ত্রিত Eccentric Training রিকভারি সময় কমায় এবং পুনরায় ইনজুরি হওয়ার ঝুঁকিও কমে।
একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশের অনেক খেলোয়াড় বিশেষ করে স্প্রিন্টার, ফুটবলার ও ক্রিকেটাররা হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে ভুগছে কারণ তারা ওয়ার্ম-আপে সময় দেয় না, ওয়ার্কলোড মনিটর করে না, এবং রিহ্যাব শেষ না করেই খেলায় ফেরে। একজন খেলোয়াড় যখন “হাফ-ফিট” অবস্থায় মাঠে ফেরে, তখন তার জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয় রি-ইনজুরি।
প্রতিরোধের কৌশল
১. Eccentric Strength Training (যেমন: Nordic Hamstring, Slider, RDLs) নিয়মিত করুন।
২. ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট করুন—প্রতিদিনের ট্রেনিং লোড ও ম্যাচ ফ্রিকোয়েন্সি মনিটর করুন।
৩. বায়োমেকানিক্যাল কারেকশন করুন—দৌড়ানোর ভঙ্গি, পেলভিক পজিশন ও স্ট্রাইড প্যাটার্ন ঠিক করুন।
৪. রিহ্যাব সম্পূর্ণ করুন—ইনজুরির পর মাঠে ফেরার আগে সব ফাংশনাল টেস্ট পাস করা জরুরি।
৫. নিয়মিত ইনজুরি স্ক্রিনিং করুন—সিজন অনুযায়ী ফ্লেক্সিবিলিটি ও রেঞ্জ অব মোশন মূল্যায়ন করুন।
শেষ কথা
হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি রোধযোগ্য ইনজুরি। সঠিক ট্রেনিং, বিশ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা মানলে একজন খেলোয়াড় তার গতি ও শক্তি দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারে। শুধু কঠোর পরিশ্রম নয়, স্মার্ট ট্রেনিংই আজকের ক্রীড়াবিদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আত্মবিশ্বাসী থাকুন, সচেতন থাকুন, ইনজুরি-ফ্রি খেলোয়াড় হয়ে উঠুন।
লেখক : সাইফুদ্দিন আহমেদ, স্পোর্টস ফিজিওথেরাপিস্ট, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।
এইচজেএস