আমি কিংবদন্তি কি না মানুষ বলবে

সাবিনা খাতুন ও বাংলাদেশের নারী ফুটবল একে অন্যের পরিপূরক প্রায় এক দশকের বেশি সময়। দেশের বাইরে খেলা প্রথম নারী ফুটবলারসহ অনেক কিছুতেই প্রথম সাবিনা। আজ (রোববার) আরেকটি প্রথমে নিজের নাম লেখালেন। ঘরোয়া নারী ফুটবল লিগে প্রথম ‘শততম’ গোলদাতা তিনি। বিশেষ এই দিনে জাতীয় দল ও বসুন্ধরা কিংসের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন বাংলাদেশের নারী ফুটবল ও নিজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের-এর সঙ্গে।
প্রশ্ন: প্রথমেই অভিনন্দন। নারী ফুটবলে নতুন একটি মাইলফলক স্পর্শ করলেন। নারী ফুটবল লিগ অনিয়মিত। নিয়মিতভাবে হলে শততম গোলের স্পর্শ আরো আগেই পেতেন-
সাবিনা: হ্যাঁ এটা ঠিকই বলেছেন। আমাদের নারী লিগ নিয়মিতভাবে হয়না। এজন্য ১০০ গোলের স্পর্শ করতে সময় লেগেছে। নিয়মিতভাবে হলে আরো আগেই এই মাইলফলক স্পর্শ করতে পারতাম।
প্রশ্ন: গত বছর ও এই বছর টানা লিগ হচ্ছে। বাফুফের নারী উইং প্রতি বছর লিগ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। লিগে নিজের গোলসংখ্যাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান ?
সাবিনা: অবশ্যই আরো অনেক গোল করতে চাই। নিজেকে এমন এক জায়গায় নিতে চাই যেই রেকর্ড সবাই ভাঙতে পারবে না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল লিগে এখন পর্যন্ত শেখ আসলামের ১৭৭ গোলের রেকর্ড সর্বোচ্চ। সেই রেকর্ডের দিকেই এখন আপনার চোখ নিশ্চয়ই।
সাবিনা: আসলে তারা কিংবদন্তি ফুটবলার। পুরুষ ফুটবল এবং তাদের মতো ফুটবলারের সঙ্গে তুলনাটা খুব প্রাসঙ্গিক মনে করি না। আমি আমার স্বাভাবিক খেলা খেলে গোল করে যেতে চাই। ক্যারিয়ার শেষে দেখা যাবে। কত গোল দাঁড়াল; এর আগে নিয়মিতভাবে গোল করে যেতে চাই।
প্রশ্ন: উত্তরে ‘কিংবদন্তি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। দেশের বাইরে প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে লিগ খেলেছেন। লিগে শততম গোল করলেন। ঘরোয়া বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে তিন শতাধিক গোল। আপনি নিজেকে কিংবদন্তির কাতারে দেখছেন কিনা নারী ফুটবলে ?
সাবিনা: আসলে আমি নিজেকে এখনো সেভাবে চিন্তা করছি না। আমার খেলা, পারফরম্যান্স ও অবদানে মানুষ বলবে আমি কিংবদন্তি কিনা। কিংবদন্তীর বিষয়টি আমি নই, মানুষের উপরই ছেড়ে দিলাম।
প্রশ্ন: নারী ফুটবলে আইকন বলতে এখন প্রথম ফিফা রেফারি জয়া চাকমা ও সাবিনা খাতুন। জয়া চাকমা ও আপনার মধ্যে জনপ্রিয়তা ও আইকনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিভাবে দেখছেন?
সাবিনা: আমি ব্যক্তিগতভাবে সেভাবে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখি না। সে রেফারি হিসেবে নিজেকে আলাদা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমি এখনো খেলছি, খেলার মাধ্যমে বিভিন্ন কীর্তি ও রেকর্ড গড়ছি। সে তার জায়গায় সেরা, আমি আমার জায়গায়। আমাকে যেমন মেয়েরা অনুসরণ করে , নারী রেফারিরা তাকেও অনুসরণ করে বেড়ে উঠবে।
প্রশ্ন: আপনি ইতোমধ্যে কোচিং কোর্স করেছেন। অনূর্ধ্ব জাতীয় দলগুলোর কোচিং স্টাফেও রয়েছেন। ক্যারিয়ার শেষে কোচ হিসেবেই দেখা যাবে আপনাকে?
সাবিনা: আমি খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করার পর ফুটবলের সঙ্গেই থাকব। সেটা কোচ হিসেবেও হতে পারে আবার অন্য কোনো হিসেবেও। ফুটবলেই থাকব এটা শতভাগ নিশ্চিত।
প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক অঙ্গনেই যেখানে আপনি গোল করেন, হ্যাটট্রিক করেন। সেখানে ঘরোয়া ফুটবলে কোনো ডিফেন্ডার বা গোলরক্ষক তো আপনার কাছে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না। এরপরও কোন গোলরক্ষককে পরাস্ত করতে আপনার সমস্যা হয় ?
সাবিনা: জাতীয় দলের গোলরক্ষক ছিলেন সাবিনা আক্তার। ও’কে পরাস্ত করা কষ্ট ছিল। আমাদের দলে এখন আছে রুপনা চাকমা। ও ভালো গোলরক্ষক।
প্রশ্ন: গত এক দশকে আপনার সেই অর্থে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এটি একটি দেশের ফুটবলের জন্য খুব সুখকর কিছু নয়। নিজের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বিতা কিভাবে দেখেন ?
সাবিনা: আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে কৃষ্ণারা কিন্তু এখন ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করছে। মেয়েদের ফুটবলে অবশ্যই আগের চেয়ে অনেকটা এগিয়েছে। বিশেষ করে অনুর্ধ্ব পর্যায়ে তো আমরা এশিয়ার অন্যতম সেরা দল। খেলার স্টাইলে এসেছেও অনেক পরিবর্তন ও আধুনিকতা।
প্রশ্ন: ঘরোয়া ফুটবলে আপনার গোলের পর গোল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সিনিয়র নারী দল তেমন ম্যাচ খেলছে না। অনুর্ধ্ব পর্যায়ে বেশি ম্যাচ হচ্ছে। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সেভাবে খেলতে না পারার বিষয়টি কেমন পীড়া দেয় ?
সাবিনা: সাফ ছাড়া আসলে আমাদের সেই রকম খেলা থাকে না। ফেডারেশন মাঝে উদ্যোগ নিয়েছিল নারী ফুটবলেও প্রীতি ম্যাচ আয়োজনের। করোনা ও নানা বাস্তবতায় হয় না। তবে আমি মনে করি পুরুষ ফুটবলের মতো আমাদেরও মাঝে মধ্যে প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন: পুরুষ ফুটবলের প্রসঙ্গ মিলিয়ে একটি প্রশ্ন করতে চাই। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবলের অধিকাংশ সাফল্যই নারী ফুটবলে। পুরুষ ফুটবলে ব্যর্থতার গল্পই বেশি। এরপরও ঘরোয়া ফুটবলে পুরুষ ফুটবলে অর্ধ কোটির বেশি পারিশ্রমিক পায় অনেকে। আন্তর্জাতিক সাফল্যের পরেও আপনাদের পারিশ্রমিক ও সুযোগ সুবিধা অনেক কম।
সাবিনা: বসুন্ধরা কিংস আসার পর নারী ফুটবলারদের পারিশ্রমিক বেড়েছে। আরো কয়েকটি ক্লাব ও কর্পোরেট দল এগিয়ে আসলে তখন নারীদেরও পারিশ্রমিকও ভালো হবে।
প্রশ্ন: নারী লিগ একপেশে হয়। এজন্য অনেকে পুলের প্রস্তাব করেন। এতে আপনার মত কি ?
সাবিনা: আমিও এক সময় মনে করতাম হয়তো পুল হলে ভালো। কিন্তু পরে বুঝছি এতে ফুটবলারদের জন্য ক্ষতি। কারণ এতে ফুটবলাররা পারিশ্রমিক পাবে না। পুল না করে কয়েকটি বড় ক্লাব ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আসলেই এই সমস্যা অনেকটা কাটবে।
প্রশ্ন: মানসম্মত নারী ফুটবলারদের সংখ্যা খুবই সীমিত। দুইটি দলও পুরোপুরি হয়না। সেক্ষেত্রে বড় ক্লাব ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে কেন। এর চেয়ে যদি ক্রিকেটের বিপিএলের মতো ক্যাটাগরি ও আইকন ভিত্তিকভাবে সম্মানজনক পারিশ্রমিক নির্ধারণ হয়। সেটি কেমন হবে ?
সাবিনা: সেক্ষেত্রেও হয়তো কিছু জটিলতা থাকবে। তখন পারিশ্রমিকের একটা নিশ্চয়তা মিললেও পজিশনগত ফুটবলাররা আবার বিপদে পড়তে পারে। তবে একটা সুষ্ট ও সুন্দর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগ হোক সেটাও আমাদের চাওয়া।
প্রশ্ন: আপনার সাথে শুরু করা অনেক ফুটবলার এখন ফুটবল থেকে দূরে এবং অনেকের সেই ফর্ম নেই। আপনি এখনো দোর্দন্ড প্রতাপে খেলছেন। এর পেছনে মূল কারণ কি ?
সাবিনা: আমি আল্লাহর রহমতে কোনো ইনজুরিতে পড়িনি। ফুটবল নিয়েই ভেবেছি, নিজেকে পেশাদার ফুটবলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছি। এর পেছনে আমি বেশি অবদান দেব জাতীয় দলের কোচ ছোটন স্যারকে। তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য।
প্রশ্ন: পেশাদার ক্রীড়াবিদরা অনেকেই পড়াশোনার ব্যাপারে উদাসীন। আপনি সাভার গণবিশ^বিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনা করছেন। খেলা ও পড়া কিভাবে সমন্বয় করেন?
সাবিনা: শুধু ক্রীড়াবিদ নয়, প্রতিটি মানুষেরই পড়াশোনা করা উচিত। ব্যস্ত সূচির মধ্যেও আমি চেষ্টা করি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার। কষ্ট হয় এরপরও করি। হয়তো এই কষ্টও একদিন আমাকে একটা বিশেষ কিছু দেবে।
প্রশ্ন: আপনার খেলোয়াড় ক্যারিয়ার দিয়েই শেষ করি। নিজেকে কোথায় রেখে ক্যারিয়ার শেষ করতে চান ?
সাবিনা : নিজের ক্যারিয়ারকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে চাই। এমন একটা জায়গা রেখে যেতে চাই যা সবাই অনুসরণ করবে। পরবর্তীতে মেয়েরা যারা আসবে আমাকে অতিক্রম করার লক্ষ্য নিয়ে আসবে। আমার সেই রেকর্ড যেন সহজে ভাঙতে না পারে।
এজেড/এটি
