‘অলিম্পিকের মহাসচিব, সহ-সভাপতি প্রার্থীতায় স্বার্থের সংঘাত’

দেশের অনেক ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে স্বার্থের সংঘাত। চলমান বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের (বিওএ) নির্বাচনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন তুলেছে। গত মঙ্গলবার বিওএ নির্বাচন কমিশন বরাবর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (ক্রীড়া) আমিনুল এহসান এক চিঠি দিয়েছেন। সেখানে সার্চ কমিটির আহ্বায়ক ও অন্যতম সদস্য জোবায়েদুর রহমান রানা ও মেজর ইমরোজ আহমেদের (অব) মহাসচিব ও সহ-সভাপতি প্রার্থীতা স্বার্থের সংঘাত হিসেবে আখ্যায়িত করে নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের জন্য গত বছর ২৯ আগস্ট সার্চ কমিটি গঠন করেছিল ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন জোবায়েদুর রহমান রানা ও অন্যতম সদস্য সাবেক হকি খেলোয়াড় মেজর ইমরোজ আহমেদ (অব)। সার্চ কমিটির কার্য পরিধির মধ্যে ছিল মূলত গঠনতন্ত্র সংস্কার, ফেডারেশন নির্বাচন বিধিমালা, বিদেশে দল প্রেরণের নীতিমালা পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পেশ করা। পরবর্তীতে সার্চ কমিটি ফুটবল, ক্রিকেট বাদে সকল ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি গঠন দায়িত্ব পালন করে। যদিও আনুষ্ঠানিক চিঠিতে তাদের এটি কাজের আওতায় ছিল ছিল না।
সার্চ কমিটির সুপারিশ বা প্রস্তাবনার ভিত্তিতেই মূলত ৪৯ ফেডারেশন/এসোসিয়েশন গঠন হয়েছে। অলিম্পিক এসোসিয়েশনের অধীভুক্ত ২৫ ফেডারেশন, নন অলিম্পিক ৩ ফেডারেশন ও মহিলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে অলিম্পিকের নির্বাচনে কাউন্সিলর সংখ্যা ৫৫। যা বিওএ সভাপতি কোটায় (কাউন্সিলর) মহাসচিব ও সহ-সভাপতি প্রার্থী হওয়া রানা ও ইমরোজের সুপারিশকৃত কমিটির বলে উল্লেখ করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। যা কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট (স্বার্থের সংঘাত) হওয়ার সুযোগ দেখছে এনএসসি।
সার্চ কমিটির সুপারিশ বা প্রস্তাবে অনেক ফেডারেশন গঠন হলেও আবার অনেক ফেডারেশনে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়/জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ রদবদল করেছে। যা পরবর্তীতে সার্চ কমিটি নিজেদের সুপারিশকৃত নয় বলে দাবি করেছেন। তন্মেধ্যে আরচ্যারি, শুটিং ফেডারেশনের সভাপতি, মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, শুটিং ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক সহ আরো বেশ কয়েকটি ফেডারেশনের বেশ কয়েকটি পদ। সার্চ কমিটি সুপারিশ না করা অনেকেই আবার অলিম্পিকের নির্বাচনে কাউন্সিলর হয়েছেন। তবে সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত ব্যক্তিবর্গ ফেডারেশন থেকে অলিম্পিকে কাউন্সিলর সংখ্যাও বেশ বড়ই। তন্মেধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবল, তায়কোয়ান্দো, বাস্কেটবল, হকি, টেনিস, টেবিল টেনিসসহ আরো কয়েকটি ফেডারেশনের প্রতিনিধি রয়েছে। অলিম্পিকের নির্বাচনে এরাই মূলত প্রার্থী হয়েছেন। যারা ফেডারেশন গঠন করেছেন তারাই আবার তাদের মনোনীত প্রতিনিধি দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া স্বার্থের সংঘাত দেখছেন ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই।
১৪ নভেম্বর প্রথম দফায় এক যোগে ৯টি ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি গঠন হয়। এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফেডারেশন পুর্নগঠন হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনে অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ বিগত সময়গুলোতে প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত থাকত ৯০ দিন এবং দ্রুত সময়ে নির্বাচন। এবার সেই রকম কিছু ছিল না। এক বছর পেরিয়ে গেলেও সার্চ কমিটির অ্যাডহক কমিটি দিয়েই চলছে ফেডারেশনগুলো। আবার সার্চ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে মাস পাচেক আগে। সার্চ কমিটির দায়িত্ব পালন করা কেউ ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এ রকম কোনো আইন বা নির্দেশনা ছিল না জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বা মন্ত্রণালয়ের। তাই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি মূলত মূল্যবোধ ও নৈতিকার উপরই।
টেনিস ফেডারেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সাবেক উপ-মহাসচিব ইসতিয়াক আহমেদ কারেন সার্চ কমিটির ব্যক্তিবর্গের অলিম্পিকে প্রার্থী হওয়া নৈতিকতা পরিপন্থি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘অলিম্পিক শুধু খেলা নয়, অলিম্পিক স্পিরিট ও অলিম্পিয়াজমের বিষয়। ভ্রাতৃত্ববোধ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অলিম্পিকে অনেক বড় বিষয়। সার্চ কমিটির ব্যক্তিবর্গ ফেডারেশন পুর্নগঠন করেছেন। সেই ফেডারেশনের প্রতিনিধিদের দিয়ে তাদের অলিম্পিকের নির্বাচনে অংশগ্রহণ স্বার্থের সংঘাত এবং নৈতিকার পরিপন্থী। যা অলিম্পিকের স্পিরিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণও নয়।’
রানা সার্চ কমিটির আহ্বায়ক হওয়ার পর থেকে ক্রীড়াঙ্গনে গুঞ্জন ছিল তিনি অলিম্পিকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। সার্চ কমিটির মেয়াদ শেষে ফেডারেশনের সেক্রেটারিদের নিয়ে সংগঠন পুর্নগঠন হয়। রানা কোনো ফেডারেশনে না থাকলেও সেই অনুষ্ঠানে থাকতেন মধ্যমণি হিসেবেই। যা ক্রীড়াসংশ্লিষ্টদের অনুমান ছিল, আসন্ন অলিম্পিক নির্বাচন ঘিরেই এমন উপলক্ষ্য। গুঞ্জন-অনুমানই সত্যতায় পরিণত হয়েছে পরবর্তীতে। সার্চ কমিটির সুপারিশ না রাখায় বা বিতর্কিত ব্যক্তিদের ফেডারেশনের কমিটিতে ঢুকানোয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তীব্র সমালোচনা করতেন রানা ও ইমরোজ। সময়ের প্রেক্ষাপটে এখন তারাই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্বার্থের সংঘাত প্রশ্নের কাঠগড়ায়।
অলিম্পিকের নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থীতা প্রকাশ হওয়ার পর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে। রানা ও ইমরোজের পদে অতিরিক্ত প্রার্থী না থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী পরিচালক কাজী নজরুল ইসলাম অলিম্পিক এসোসিয়েশনের কাউন্সিলর। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়েরও প্রতিনিধি রয়েছে অলিম্পিকের কাউন্সিলর হিসেবে। কাউন্সিলর তালিকা, মনোনয়ন পত্র উঠানো, জমা ও খসড়া প্রার্থী তালিকাতেও ছিল রানা ও ইমরোজের নাম। কাউন্সিলর ও মনোনয়ন উভয় ক্ষেত্রে আপত্তির সুযোগও ছিল নির্বাচনী তফসিলে। এত বিলম্বে চিঠি প্রদানের বিষয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক ক্রীড়া আমিনুল এহসান বলেন, ‘প্রার্থীতা প্রত্যাহার ও চূড়ান্ত প্রার্থীতা প্রকাশের আগ পর্যন্ত আমরা কিছু বলতে পারি না। প্রার্থীতা চূড়ান্ত হওয়ার পর এখন আমরা নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।’ নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষন করলেও তাদের পদক্ষেপ বা কোনো প্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া যায়নি। আজ কয়েক বার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম এম সালেহীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশনার ড শেখ মোহাম্মদ জোবায়েদ হোসেন এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন, ‘আমরা চিঠি পেয়েছি। এই বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারই মন্তব্য করবেন।’
জোবায়েদুর রহমান সাবেক ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতি ছিলেন। অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সদস্যও ছিলেন এক যুগ আগে এবং ২০১০ এসএ গেমস আয়োজক কমিটির অন্যতম একজন ছিলেন। খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে অলিম্পিকে নির্বাচনে কাউন্সিলর হওয়া এবং মহাসচিব পদে নির্বাচন করার যোগ্যতা, অধিকার রানার থাকলেও সার্চ কমিটির আহ্বায়ক হওয়ার পর অলিম্পিকের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় মূলত নৈতিকতা ও স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন উঠেছে। তদ্রুপ সাবেক হকি খেলোয়াড় ও সংগঠক মেজর ইমরোজ আহমেদের (অব) ক্ষেত্রেও।
এজেড/এইচজেএস