মেসি, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!

অভিমানী মেঘ মাথার উপর ভেসে বেড়াচ্ছে বারবার। টুপ টুপ বৃষ্টি মাঝেমধ্যেই জানান দিচ্ছে বিষণ্নতা। ভোরের শুনশান নীরবতা যেন থমকে দিয়েছে সব। চারদিকে আজ শূন্যতার শোকসভা। ব্রাজিলের মারাকানা থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব কত? চাঁদপুরের অজপাড়া গা সেদিন কেমন নিস্তব্ধ। কেবল মেসির জন্য; হ্যাঁ, কেবলই তার!
বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া বুড়োটা, তখন মুহূর্তেই করে ফেলতে পারেন যা কিছু সম্ভব, তেমন টগবগে তরুণ, অথবা ওই ছোট্ট বাচ্চাটা, যে কিছুই বুঝে না আদতে; চোখ মেলে থাকতে কষ্ট হয় ভীষণ। কখনো তো এত রাত জাগা হয় না। তবুও সে চোখে পানি দেয় বারবার, ঘুমাতে চায় না আর। আজকের রাতটা যে লিওনেল মেসির হওয়ার কথা!
কিন্তু হায়, মারিও গোয়েটজা শেষ করে দিয়েছেন সব। চারদিকে এখন হাহাকার, হাপিত্যেস আর অভিমানের মেঘে মিশে যাওয়ার অপেক্ষা। সবার বেদনা একটাই, মুখ ফুটে বলতে না পারা বাক্যটাও এক, ‘মেসি, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!’
*
ফুটবলটা প্যাঁচানো হয়ে গেছে বেশ। আদতে হয়ে পড়েছে দাবাও। দুই জন খেলোয়াড় যেন ডাগ আউটে বসে ঘুঁটি চালছেন দাবার। দুই রঙের জার্সিতে এগারোজনের মাঠের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে ছুঁটে চলা যেন দাবারুদেরই চাল।
এই কেন্দ্রিক সবকিছুও তাই হয়ে গেছে এমন। লেখা, বিশ্লেষণ কিংবা অন্যকিছু। টেকনিক্যাল-ট্যাকটিকাল আলোচনা থাকাই চাই। কিন্তু পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত। বাংলাদেশ থেকে সুদূর ব্রাজিল। বয়সের পার্থক্য যে ভুলে গেছে সবাই। অথবা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার সবটাতে যে ছড়িয়ে পড়ল ফুটবল। আবেগ না হলে তা কী করে সম্ভব হতো!
কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে তাই বলে দেওয়াই যায়, অন্তত ৮০ ভাগ মানুষের কাছে ফুটবলটা এখনো আবেগেরই খেলা। দুই সাইটে তিনটে করে কাঠি, এর ভেতর দিয়ে চলে গেলে গোল। যে যত বেশিবার নিতে পারবেন, সেই জিতে যাবেন ম্যাচ। এতে এত জটিলতারই বা কী আছে!
*
আবেগ যদি ফুটবল হয়, লিওনেল মেসি তাহলে কী? তিনি তাহলে বর্ষার বিলভর্তি পানি। অবশ্যই ওই বৃষ্টি আকাশ থেকে পড়ে না। মারিও গোৎজে কিংবা লিওনেল মেসি স্বয়ং ফেলেন, বিন্দু বিন্দু করে জমা হওয়া মনের ভেতর অভিমানী মেঘের পর মানুষের চোখ দিয়ে। তাও এমন একটা দেশের মানুষের, যেখানের নামটাও হয়তো ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারবেন না একবার ঘুরে গিয়েও।
ফুটবল তো আবেগই! লিওনেল মেসির একটা ছবি যেমন সেঁটে যাবে সব জায়গায়, ইতিহাস হয়ে। গুগল সার্চ কিংবা পোস্টারে, যেখানেই কেউ ছবিটা দেখবে। মনে পড়বে মেসিকে। আর যদি আর্জেন্টিনা অথবা মেসিকে তিনি ভালোবেসে থাকেন জীবনে একদিন?
তাহলে শীতের রাতে কুয়াশায় নিজেকে হারাতে দেওয়ার অনুভূতি হবে নিশ্চিত। চারদিকের পথটা চেনা যাবে না, অন্ধকার হয়ে আসবে। তীব্র শীতে হাড়ে বয়ে যাবে কাঁপুনির অনুভূতি। কোন ছবি? যে ছবিটাতে দেখা যায়, এক হাত দূরের বিশ্বকাপটা মেসি ছুঁয়ে দেখতে পারেন না!
আচ্ছা, ফুটবল যদি আবেগেরই খেলা না হবে, তাহলে মেসি কেন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার নিতে গিয়েও একবারও বিশ্বকাপটার দিকে তাকাবেন না?
*
মেসিকে নিয়ে এতকিছু বলে ফেলা হলো। কিন্তু আসল ঘটনাটাই বলা হলো না! তবে এতটুকু দায়িত্ব তো নেওয়াই যায়, এই লেখাটা যারা পড়তে এসেছেন, তারা অন্তত জানেন মেসি কে। এখানে কোন আক্ষেপ বেদনার কাব্য হচ্ছে, সেটাও তো বুঝতে পারার কথা।
১৪ জুলাই, ২০১৪ সালে জার্মানির কাছে আর্জেন্টিনা অথবা মেসিদের বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু কি ঘটেছিল? অন্তত সব ছাপিয়ে পৃথিবীতে সেটিই যে ছিল মেইন ইভেন্ট, সেটা অস্বীকার করবে কে!
কিন্তু মেসি না হয় বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে গেছেন, তাই বলে এত বেদনার কী আছে? আছে। কারণ নামটা যে লিওনেল মেসি। দেশটা যে আর্জেন্টিনা। পতাকার রঙটা যে আকাশি-সাদা। তাদের হয়ে যে খেলতেন ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা নামে একজন। এই জার্সিতে যে খেলছেন, লিওনেল মেসি।
নিজেকে যিনি নিয়ে গেছেন এমন একটা জায়গায়, একটা বিশ্বকাপ ছাড়া তার ক্যারিয়ারটা যেখান থেকে অপূর্ণ দেখায়। কিন্তু অপূর্ণতাই যদি না থাকবে, তাহলে পূর্ণতার মাহাত্ম্য কোথায়! বিধাতার ভাবনাটা কী এমন?
নইলে, তিনি কেন বারবার মেসিকেই বেছে নেবেন। কখনো হিগুয়েন মিস করবেন সহজ গোল, কখনো চিলির বিপক্ষে মেসি কেন ট্রাইবেকারে জাল খুঁজে পাবেন না, বল মারবেন অজানায়! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
মেসি তো জালটা খুব ভালো করে চিনতেন। বরং এই প্রশ্নটাই করা যায়, তার চেয়ে ভালো গোলবারের ওই জালটাকে কয়জন বেশি চেনেন? এক, দুই, সর্বোচ্চ হলে তিন!
তবুও মেসি জাল খুঁজে পান না ট্রাইবেকারে। হিগুয়াইন পান না বিশ্বকাপ ফাইনালে। পেয়ে যান মারিও গোয়েটজা। যার কি না ফাইনাল ৯০ মিনিটে শেষ হয়ে গেলে সাইডলাইনের দাগের ভেতরই ঢুকা হতো না!
*
এটা সত্যি, আরও অনেক কিংবদন্তিই বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। অনেক মানে সংখ্যাটা আসলেই বিশাল। ইয়োহান ক্রুইফ, ফেরেঙ্ক পুসকাস, জিকো। অসংখ্য নাম। কিন্তু, তাদের কেউই কি মেসির মতো পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন দিনমজুরের কাছে?
স্যাটেলাইটের বদৌলতে হোক, অথবা অন্য কোনো কারণে। সব ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পেরেছেন তারা? তাদের কারো খেলা দেখার জন্য কি রাত তিনটায় লাফিয়ে উঠেছে কোনো কিশোর?
উঠতেই পারে। তবে সেটা তার নিজের দেশের বাইরে কয়টা জায়গায়? অন্তত বাংলাদেশে তো তেমন আবেদন তারা তৈরি করতে পারেননি। মেসি পেরেছেন। এই জন্যই তার বিশ্বকাপ না জেতা এত পোড়ায়।
মেসি পেরেছেন আরও একটি জায়গায়। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিজেকে একই রকম রেখেছেন। গোল করার ক্ষুধাটাও তার একই রকম থেকেছে। বড় কোনো ইনজুরিতে পড়েননি, পারফরম্যান্সও রেখেছেন একই রকম। এক যুগ! এত সময় কি আর কেউ পেরেছেন? পেলে অথবা ম্যারাডোনা?
*
মেসি, আজ আপনার জন্মদিন। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এইরেসে ট্রফি দেখে না তিন দশক। অর্থাৎ, এখন যারা আপনাকে দেখতে রাতের পর রাত জাগে। তাদের বেশির ভাগই ট্রফি জিততে দেখেনি আপনার দেশকে। বরং পেয়েছে বেদনা। কষ্টের কান্নাও তাদের এক সময় ফুরিয়ে গেছে। তাদের এখন কষ্ট লাগলে ভীষণ, হয়তো একটা অট্টহাসিতে ছুড়ে ফেলতে চায় সেটা। তবে অবশ্যই তারা পারে না।
তাদের কেবল মনে হয়। আপনার সঙ্গে এমন হওয়ার কথা ছিল না। অভিমানি মেঘের বদলে আকাশে রোদ্দুর উঁকি দেয়ার কথা ছিল। আপনার মুখে ঘুমোট ভাবের বদলে থাকার কথা ছিল হাসি। আপনার মাথাটা থাকার কথা ছিল উঁচু, ট্রফিটা হাতে নিয়ে। বৃষ্টির ফোঁটা মিশে যাওয়ার কথা ছিল আনন্দাশ্রুতে।
আপনার উৎসবে মেতে ওঠার কথা ছিল বুয়েন্স এইরেসে। রোজারিও-বালকের আনন্দে পৃথিবীজুড়ে কোটি ভক্তদের উল্লাস করার কথা ছিল আরও আগে। জার্মানিকে গোলটা দেয়ার কথা ছিল হিগুয়াইনের, ট্রাইবেকারে চিলিকে হারানোর কথা ছিল আপনাদের। মারিও গোয়েটজার হিরো হওয়ার কথা তো ছিল না!
আপনার একটা বিশ্বকাপ থাকার কথা ছিল এতদিন। কিন্তু কিছুই তো হলো না। বিধাতা চান না? তা তো অবশ্যই। আপনাকে হয়তো তিনি মানুষই বানিয়ে রাখতে চান না। ট্রফি না দিয়েই শত শত বছর পরও রাখতে চান আলোচনায়। কিন্তু লিওনেল, এমন কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না! তাহলে কেন এমন হলো?
এমএইচ/এটি
