গোপীবাগের বাতাসেও আজ অবনমনের কান্না

রাজধানীর ব্যস্ততম অঞ্চলের একটি ইত্তেফাক মোড়। তার গোড়াতেই গোপীবাগে ব্রাদার্স ইউনিয়নের ক্লাব টেন্ট। সব সময় চাঞ্চল্য থাকে ব্রাদার্স ক্লাবের ভেতরে ও বাইরে। আজকের সকালটি একদম ব্যতিক্রম। ৪৬ বছর ধরে দেশের ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে উড়ছিল ক্লাবের পতাকা। অবনমন হওয়ার পর সেই পতাকাও যেন আলো ও বাতাসের দোলায় নিজেকে লুকানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। গোপীবাগের বাতাসেও এখন অবনমনের কান্না!
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আবাহনী ফুটবলে এনেছে আধুনিকতা, ব্রাদার্সের তারুণ্য আর মোহামেডানের ঐতিহ্য। এই তিনে মিলে সত্তর- আশির দশকের দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা বুঁদ হয়ে থাকতেন ফুটবলে। সাফল্যের বিচারে মোহামেডান ও আবাহনীর চেয়ে ব্রাদার্স অনেক পিছিয়ে থাকলেও দেশের ফুটবলে বিশেষ কিছু রেকর্ড যা শুধু ব্রাদার্সেরই।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আগাখান গোল্ডকাপে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেশীয় ক্লাবদের মধ্যে একমাত্র ব্রাদার্সের। আবাহনী মোহামেডানের এই কৃতিত্ব নেই। মোহামেডান স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলে আগাখান গোল্ডকাপ এককভাবে চ্যাম্পিয়ন হলেও স্বাধীনতার পরে আর ট্রফি জিততে পারেনি। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবলে পা দিয়ে ছয় বছরের মাথায় আন্তর্জাতিক শিরোপা। সেই দলের অধিনায়ক আবদুস সালাম খুব ব্যথিত আজকের অবস্থানে, ‘আমাদের এত অর্জন, ত্যাগ সব কিছুই যেন ম্রিয়মাণ মনে হচ্ছে। কাল থেকে মনটা খুবই খারাপ। ব্রাদার্স ইউনিয়ন নিচের সারিতে খেলবে এটা ভাবতেই কষ্ট লাগছে।’
সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল। আবাহনীর টুটুল হিসেবে পরিচিত হলেও দুই বছর ব্রাদার্সে খেলে আগাখান ট্রফি জয়ের স্বাদ পেয়েছেন। ব্রাদার্সের অবনমনে খুবই ব্যথিত টুটুল, ‘ব্রাদার্সের মতো ক্লাব নেমে যাওয়া ফুটবলের জন্য খুবই অশনি সংকেত। দেশের ফুটবলে মাঠ ও মাঠের বাইরে এর অভাব অনুভূত হবে অনেক।’
দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক সাফল্য ছাড়াও ঘরোয়া ক্ষেত্রেও বিশেষ কীর্তি রয়েছে। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া ফেডারেশন কাপের প্রথম আসরের যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ব্রাদার্স ইউনিয়ন। ঢামফা কাপেরও অভিষেক চ্যাম্পিয়ন গোপীবাগের দলটি। ২০০৩-০৪ মৌসুমের দিকে ব্রাদার্স লিগ শিরোপা জেতে। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ১৯৮৫ সালে ব্রাদার্স লিগ চ্যাম্পিয়ন হতো। শেষ ম্যাচে আবাহনীর সঙ্গে ২-০ গোলে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলে হেরে ব্রাদার্স রানারআপ হয়। সেই দলের অধিনায়ক শফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘৮৫ সালের লিগের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপুর্ণ লিগ বাংলাদেশে আর হয়নি। আবাহনী ৫১, ব্রাদার্স ৫০ আর মোহামেডান ৪৯ পয়েন্ট। সবার সাথে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধান। ব্রাদার্সের এত সোনালী দিন এভাবে শেষ হবে কল্পনাও করিনি।’
মানিক চলতি লিগে শেখ জামালে কোচিং করিয়েছিলেন। দুর্বল দল হলেও ব্রাদার্স রেলিগেশনে যাওয়ার মতো ছিল না বলে মনে করেন এই সাবেক ফুটবলার, ‘দ্বিতীয় লেগে তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্য মিলে কয়েকটি ম্যাচ ভালোও খেলেছে কিন্তু ফলাফল অনুকূলে আসেনি।’
ব্রাদার্সের ম্যানেজার আমের খান বাফুফে নির্বাহী সদস্য হয়েও তার আগের মতোই প্রতিবাদী অবস্থানে। ৩০ এপ্রিল লকডাউনের মধ্যে বাফুফে খেলা শুরুর মধ্যেই লিগ শুরুর মাধ্যমে লিগে ব্রাদার্সের আরো পিছিয়ে যাওয়া বলে ধারণা তার, ‘কথা ছিল লকডাউন উঠে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর খেলা শুরু হবে। সেটা মানা হয়নি এরপর ব্রাদার্সের খেলা ৩০ এপ্রিলেই দেয়া হলো। অনুশীলন ছাড়া ওই সময় আমাদের চারটি ম্যাচ খেলতে হয়েছে। যেটা আমাদের অনেক পেছনে ফেলেছে। এছাড়া কিছু গোল বাতিল, অফ সাউড, কার্ড প্রসঙ্গ তো আছেই।’
লিগের বাইলজ অনুযায়ী প্রিমিয়ার লিগে দুটো অবনমন। করোনার জন্য এবার লিগে অবনমন না দেয়ার বিশেষ অনুরোধ আমেরের, ‘করোনার মধ্যে ক্লাবগুলো অনেক কষ্ট করে খেলেছে। আমরা এখন নয়, শুরু থেকে এবার রেলিগেশন না দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। কলকাতা লিগেও এবার রেলিগেশন নেই। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করাই যায়।’
ব্রাদার্সের অনন্য অর্জনসমূহ-
প্রথম ফেডারেশন কাপে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন (১৯৮০)
প্রথম ঢামফা কাপে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন
আগাখান গোল্ডকাপে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ( ১৯৮১)
প্রথম ফুটসাল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন (২০০৮)
পেশাদার লিগে অবনমন না থাকা অপেশাদার আচরণ তবে বাংলাদেশে পেশাদার লিগের যাত্রা শুরুই হয়েছিল রেলিগেশন না দিয়ে। ২০০৭ সালে প্রথম আসরে রেলিগেশন ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সেই যাত্রায় বেচে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টেকাতে পেরেছে।
আশি নব্বই দশকে ব্রাদার্সে তারুণ্যের উদ্দীপনা ও দেশের সেরা ফুটবলাররা খেললেও সাফল্য ছিল কালেভদ্রে। ২০০২-০৫ পর্যন্ত ব্রাদার্সের স্বর্ণযুগ। ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপ ও লিগ সবই জিতেছিল ওই সময়ে। এএফসি কাপেও বেশ দাপটের সাথে খেলেছে ব্রাদার্স। আবাহনী-মোহামেডান জুনিয়রদের ক্যাম্প করাতো না। ২০০৩-০৪ সালের দিকে ব্রাদার্স জুনিয়রদের নিয়েও ক্যাম্প করত। জাহিদ হাসান এমিলি, আরিফ, মিশুর হাতেখড়ি ব্রাদার্স থেকেই। এমিলি ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এবার দ্বিতীয় লেগে এসেছিল ব্রাদার্সকে বাঁচাতে। কাল ম্যাচ শেষে এমিলির চেহারায় ফুটে উঠছিল অবনমনের করুণ চিত্র।
পেশাদার লিগের যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে রুগ্ন চিত্রে ব্রাদার্স। প্রথম কয়েক আসর শীর্ষ চার-পাচে থাকলেও শেখ জামাল,বিজেএমসি আসার পর ক্রমেই অবস্থান পেছাতে থাকে ব্রাদার্সের। সাইফ, বসুন্ধরা আসার পর আরো। আমেরের দৃষ্টিতে এর কারণ, ‘গত কয়েক বছরে অনেক ক্লাব প্রিমিয়ারে খেলার সুযোগ পেয়েছে। ফলে পুরনো ক্লাবগুলো অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। আমরা এত দিন টিকে থাকলেও এবার পারিনি। ফরাশগঞ্জ, রহমতগঞ্জ আসা যাওয়ার মধ্যে রয়েছে। এক সময় মুক্তিযোদ্ধাও হয়তো ঝরে পড়তে পারে।’
১৯৭৫ সালে ঢাকা আবাহনীকে হারিয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবলে অভিষেক ব্রাদার্সের। সেই বছর থেকে ক্লাব সেক্রেটারির দায়িত্বে সাদেক হোসেন খোকা। ব্রাদার্সের সংগঠক থেকে ধীরে ধীরে ফুটবল ফেডারেশন ও রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হন খোকা। তিনি যখন মেয়র তখনই ব্রাদার্স ক্লাবের সেরা সময় ছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ক্লাবের উথান পতন হয়েছে।
গত এক দশক ধরে ব্রাদার্স ক্লাবের সেক্রেটারি/ডিরেক্টর ইনচার্জের দায়িত্বে মহিউদ্দিন আহমেদ মহী। যিনি যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও গত দশ বছরে ক্লাবের পারফরম্যান্সে কোনো উন্নতি নেই। এই ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ব্রাদার্স ক্লাবে কেউ অনুদান দিতে চায় না। অনেক কষ্ট করে অনুদান সংগ্রহ করে টিকিয়ে রাখছিলাম। নতুন নতুন দল আসায় খেলোয়াড়দের দামও অনেক চড়া। ফলে টিকে থাকার জন্য দল গড়াও বেশ কষ্টসাধ্য। গত কয়েকবছর আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। ফুটবলে আমাদের পৃষ্ঠপোষক ইন্তেকাল করায় চাপে পড়েছি আর করোনায় আরো বেশি।’
মহী গত দুই মেয়াদে বাফুফে সহ-সভাপতি। ম্যানেজার আমের খান, ক্লাবের আরেক পরিচালক মহিদুর রহমান মেরাজও এবার বাফুফে সদস্য। এই প্রসঙ্গে মহির বক্তব্য, ‘ফুটবল ফেডারেশন ও ক্লাব দুটো ভিন্ন বিষয়। ফেডারেশনের অনেকে রয়েছেন ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। আমি ক্লাবের পাশাপাশি ফেডারেশনে থেকে ফুটবলে আরো কাজ করতে চেয়েছি। এজন্য ফুটবল ফেডারেশনে নির্বাচন করেছি।’
নির্বাচনে জিততে তারা যতটা পরিশ্রমী ছিলেন দলকে এবার বাঁচাতে সেই ভূমিকায় দেখা যায়নি।এবারের নির্বাচনের পর ছিল দলবদল। সেই দলবদলে সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পর খেলোয়াড় নিবন্ধন তালিকা জমা দেয়ায় লিগ খেলার অনুমতি পেতে ফিফা পর্যন্ত বিষয়টি গড়িয়েছে। মাঝে বেশ কয়েক ম্যাচ খেলেছে কোচ ছাড়াই।
ইত্তেফাক মোড়ের মতো জায়গায় কয়েক বিঘার উপর ক্লাব টেন্ট। পাশে অনুশীলনের মাঠ। এমন অবকাঠামোর পাশাপাশি ২০১৪ সালে লিমিটেড কোম্পানি করে ব্রাদার্স ইউনিয়ন। লিমিটেড হলেও ক্লাবে কোনো গতিশীলতা আসেনি। সাবেক তারকা ফুটবলারদের মধ্যে একমাত্র ওয়াসিম ইকবালকে প্রয়োজনে ডাকে বর্তমান কমিটি। বাকিদের সেভাবে ডাকেও না। সাবেক তারকারা টেকনিক্যাল সাহায্য দিতে পারলেও মুল সংকটের জায়গা আর্থিক খাতে তেমন কিছু করতে পারেন না।
ব্রাদার্স আগে ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট, ভলিবল, দাবা খেলত। এখন অবশ্য শুধু ক্রিকেট ও ফুটবল। ক্রিকেট প্রিমিয়ারে টিকে আছে আর ফুটবল নেমে গেল। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমনে ক্যারিয়ারে বেশ কয়েক বছর কেটেছে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের টেন্টে। ব্রাদার্সের ফুটবল দলের অবনমনে ব্যথিত সুমন। বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের প্রথম অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু ভীষণ ফুটবল ভক্ত। তার শৈশবকাল কেটেছে ওয়ারী-গোপীবাগে। ১৯৭৩-৭৪ সালে ব্রাদার্স যখন দ্বিতীয় বিভাগে তখন থেকে ব্রাদার্সের ফুটবল দেখেন লিপু। সেই ব্রাদার্স প্রিমিয়ার থেকে নেমে যাওয়ায় দুঃখবোধ করছেন লিপুও।
আবাহনী মোহামেডানের বাইরে বাংলাদেশের ফুটবলে রুপকথার অন্যতম চরিত্র বাবলু, মহসিন, ওয়াসীম। দেশের চলচ্চিত্র জগতের অনেকে ব্রাদার্সের সমর্থক ছিলেন। বিশিষ্ট পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম ব্রাদার্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় রাজ্জাক, রুনা লায়লারা ব্রাদার্সের সমর্থন করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ চৌধুরী। শিক্ষা ছুটিতে স্কটল্যান্ড থাকলেও প্রিয় দল ব্রাদার্স ইউনিয়নের খোঁজ রাখেন নিয়মিত। গতকাল অবনমন হয়ে যাওয়ার পর সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে হতাশ কন্ঠে বলেন, ‘আমার মতো অসংখ্য তরুণদের প্রতীক ছিল ব্রাদার্স। ১৯৯১ সালে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত স্মরণীয়। গত কয়েক বছর ধরেই অবনমনের শঙ্কা ছিল। এবার হয়েই গেল। আশা করি সামনের বছরই ফিরুক। কিন্তু ভয় হচ্ছে ব্রাদার্স না ওয়ারী ওয়ান্ডারার্স হয়।’
এজেড/এটি
