বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক ‘রাজা’র গল্প

২০১৯ সালের অক্টোবর। সিলেট বিভাগীয় দলের মূল পেসারত্রয়ী আবু জায়েদ চৌধুরী রাহী, খালেদ আহমেদ ও ইবাদত হোসেনরা জাতীয় দলকে সার্ভিস দিতে ব্যস্ত। তানজিম হাসান সাকিবও অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। জাতীয় লিগে পেসারশূন্য অবস্থা সিলেট দলের! শূন্যতা পূরণে আরও কয়েকজন পেসারকে ডাকা হলো নেটে। তাদের মধ্যে একজন নজর কাড়লেন সহজেই। তাঁর বলের গতি আর মুভমেন্ট, চমৎকার রিস্ট পজিশন দিয়ে দৃষ্টি কেড়ে নেয় বোলিং কোচ নাজমুল হোসেনের। এই নাজমুল হোসেনকে চিনতে পারছেন? বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক পেসার।
আর যিনি নজর কাড়লেন, তিনি হলেন রেজাউর রহমান রাজা। আপনার অনুমান ভুল নয় একরত্যি! এই রাজাই পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের জন্য বাংলাদেশ দলে ডাক পেয়েছেন।
রেজাউর রহমান রাজা সিলেটের ছেলে। স্পষ্ট করে বললে, সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার কুরুয়া গ্রামে ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম তার।
উনিশে ফিরে যাওয়া যাক। নাজমুল হোসেন যে আস্থা নিয়ে সিলেট বিভাগীয় দলে ডেকেছিলেন রাজাকে, এর প্রতিদান দিতে শুরুতে ব্যর্থ ছিলেন তিনি। রাজশাহীতে হওয়া জাতীয় লিগে বরিশালের বিপক্ষে সেই ম্যাচে মধ্যাহ্ন বিরতির আগেই ২৭টি নো বল দিয়েছিলেন রাজা! এলোমেলো বোলিংয়ে লাইন আর লেন্থ খুঁজে পেতে হয়রান ছিলেন এই ডানহাতি পেসার। পরের ম্যাচেই তাই একাদশ থেকে বাদ।
এই কঠিন শুরুর পর রেজার ভবিষ্যতযাত্রা আরও কঠিন হতে পারতো। হয়তোবা হারিয়েই যেতেন কালের অতলে। কিন্তু বোলিং কোচ নাজমুল হোসেনের অভিজ্ঞ চোখ জহুরি চিনতে ভুল করেনি! তিনি আস্থা রেখেছিলেন রাজার ওপর। সঙ্গে সিলেট বিভাগীয় দলের কোচ, বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক রাজিন সালেহও সমর্থন যুগিয়ে গেছেন নিত্য।
সেবার জাতীয় লিগে প্রথম ম্যাচের পর একাদশ থেকে বাদ পড়লেও ফেরার প্রত্যয় হারিয়ে যায়নি রেজাউর রহমান রাজার। কোচের দিকনির্দেশনা মেনে করে গেছেন কঠোর পরিশ্রম। ঘন্টার পর ঘন্টা ঘাম ঝরিয়েছেন নেটে। এর প্রতিদান পেতেও সময় লাগেনি তাঁর। তৃতীয় ম্যাচেই ফিরলেন একাদশে; এবার দেখালেন ভিন্ন রূপ। দারুণ বোলিংয়ে যেন জানিয়ে দিলেন, ‘আমি এতো সহজেই থেমে যেতে আসিনি!’
জাতীয় লিগে অভিষিক্ত হওয়ার আগে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে পা রাখেন রাজা। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে খেলেন প্রাইম দোলেশ্বরের হয়ে। ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের বিপক্ষে ম্যাচে ৮ ওভার বল করে ৩৬ রান খরচায় নিয়েছিলেন ওপেনার ইমতিয়াজ হোসেন তান্নার উইকেট।
গেল বছর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে মিনিস্টার রাজশাহী দলের হয়ে খেলেন রাজা।
এখন অবধি খুব বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা হয়নি রেজাউর রহমান রাজার। ১০ ম্যাচে শিকার ৩৩ উইকেট। ইনিংসে পাঁচ উইকেট আছে দু’বার। ম্যাচসেরা বোলিং ফিগার ৮২ রানে ৮ উইকেট। গেল মাসেই তাঁর এ দুর্দান্ত বোলিংয়ে জাতীয় লিগের প্রথম স্তরের ম্যাচে খুলনাকে হারায় সিলেট।
লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে রাজা ৩ ম্যাচে নিয়েছেন ৬ উইকেট; ইকোনমি মাত্র ৩.৯৭! আর টি-২০’তে ১৬ ম্যাচে ঝুলিতে পুরেছেন ১৫ উইকেট; ইকোনমিও ভালো- ৬.৪৮।
জাতীয় দলকে লক্ষ্য বানিয়ে রাজার এই যাত্রা যে যথেষ্ট মসৃণ, এ নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু খানিকটা আগেভাগেই কী তাঁকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিন ময়দানে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? রাজাকে দলে ডাকা প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলছিলেন, ‘আমরা রাজাকে বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করেছি। সে বেশ শক্ত সামর্থ্য, অফুরান প্রাণশক্তির অধিকারী এবং তার উইকেট নেওয়ার প্রবণতাও বেশ ভালো।’
প্রধান নির্বাচকের এই মতের সাথে মিলে যায় সিলেট বিভাগীয় দলের কোচ রাজিন সালেহর পর্যবেক্ষণও। আলাপকালে রাজিন বলছিলেন, ‘আমি নির্বাচকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ, আমার মনে হচ্ছে সঠিক সময়ে একজন ভালো ক্রিকেটারকে দলে ডাকা হয়েছে। রাজা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর একটা ছেলে। দিনের শুরুতে যে গতিতে সে বল করে, দিনের শেষটায়ও একই গতিতে সে বল করতে পারে। তার স্ট্রেংথ যথেষ্ট শক্তিশালী। ভবিষ্যতের জন্য সে যে ভালো একটা সম্পদ, তা আমরা অনুমান করেছিলাম।’
রাজার এই পর্যায়ে আসার পেছনে তাঁর পরিশ্রম আর নাজমুলের অবদানকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন রাজিন সালেহ, ‘গেল এক-দেড় বছরে রাজা অনেক পরিশ্রম করেছে, উন্নতিও করেছে। তাঁর এই পর্যায়ে আসার পেছনে আমার চাইতেও বোলিং কোচ নাজমুল হোসেনের অবদান সবচেয়ে বেশি। রাজাকে সে অনেক সময় দিয়েছে, অনেক কাজ করেছে তাকে নিয়ে।’
যাঁর চোখে রাজা প্রথমে ধরা পড়েন, সেই নাজমুল হোসেন বলছেন, ‘প্রথম দেখাতেই রাজাকে প্রতিভাবান মনে হয়েছিল। রাজিন ভাইয়ের সাথে কথা বলে তাকে একাদশে সুযোগ দিয়েছিলাম। যদিও শুরুটা তার ভালো হয়নি। কিন্তু আমাদের আস্থার ছিল তার প্রতিভার ওপর। দলের সঙ্গে রেখে তাকে নিয়ে অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে কাজ করেছি, সে পরিশ্রম করেছে।’
নাজমুলের আশা, রাজা যেন অন্তত ১০ বছর জাতীয় দলে খেলে যেতে পারেন।
আর যাকে নিয়ে এতো কথা, সেই রেজাউর রহমান রাজা কী বলছেন? প্রথম টেস্টের ভেন্যু চট্টগ্রাম। দলের সঙ্গে গতকাল (মঙ্গলবার) সেখানে পৌঁছে গেছেন রাজা। সন্ধ্যার পর যখন ফোনে কথা হচ্ছিল, বললেন, ‘অনুমতি ছাড়া মিডিয়ায় কথা বলতে পারছি না।’
কথা না বললে কী হবে? রাজার কণ্ঠে প্রথমবার জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার উচ্ছ্বাস তো কয়েকশ’ মাইল দূর থেকেও ঠের পাওয়া যাচ্ছিল স্পষ্ট!
*লেখক: ক্রীড়ালেখক, সাংবাদিক।