ক্রিকেট, আবেগ, ফাইনাল...

Mahmudul Hasan Bappy

১৩ নভেম্বর ২০২১, ১০:৪৭ এএম


ক্রিকেট, আবেগ, ফাইনাল...

জন মিচেল একটা চাকরি করতেন। ইংল্যান্ডের রাগবি দলের সহকারি কোচ ছিলেন তিনি। ছেলে ড্যারিলের খেলা দেখার জন্য ছুটি চাইলেন হেড কোচের কাছে। পেলেন না। আপনি হলে কী করতেন তখন? যাই করুন, জন কিন্তু চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।

জিমি নিশামের টুইটটা আপনার না দেখার কোনো কারণ নেই। বাচ্চাদের ক্রিকেট ছেড়ে দিতে বলেছিলেন তিনি। ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ফাইনালে হারের পরের হতাশায়। তিনিই এবার নায়ক হয়ে নিউজিল্যান্ডকে ফাইনালে তুলেছেন। এখন বাচ্চাদের খেলার ব্যাপারে তার মত কী? এখনও জানা যায়নি সেটি।

এবারের বিশ্বকাপেরই আরেকটা ঘটনা নাও জানা থাকতে পারে আপনার। নামিবিয়ার অধিনায়ক গেরহার্ড ইরাসমাস। বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতি ম্যাচে আঙ্গুলটা ভেঙে গিয়েছিল তার। বাড়িতে যাওয়ার দরকার ছিল। তিনি গেলেন না। ইঞ্জেকশন নিলেন, চালিয়ে গেলেন খেলা। দেশকে বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাননি ইরাসমাস। 

পাপুয়া নিউগিনির খেলার ধরনটা কেমন? জানতে চাওয়া হয়েছিল অধিনায়ক আসাদ ভালার কাছে। তিনি বলেছিলেন, ‘যা কিছুই করি না কেন, আমরা কেবল হাসি। খেলতে ভালোবাসি আমরা। যেভাবে খেলি, সেটা আলাদা। উইকেটের উৎযাপন যেভাবে করি, সেটা আলাদা অন্য দেশের চেয়ে। কারণ আমরা উদযাপন ও দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে ভালোবাসি।’

অথবা ওয়েডের কথাই ধরুণ। টানা তিন ছক্কায় অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে তুলেছেন যিনি। দলে জায়গাটা কখনোই পাকা করতে পারেননি, ভেবেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালটাই তার শেষ ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে। কে জানতো, মঞ্চটা তার জন্য বাদ পড়ার নয়, নায়ক হওয়ার!

বিশ্বকাপ মানে লড়াই। ভালো ক্রিকেট খেলার প্রতিযোগিতা। আর কী? আবেগ অবশ্যই। ইরাসমাস, ড্যারিল মিচেলের বাবা কিংবা ওয়েড- নানা রূপে দেখা মেলে এটির। ডেভেন কনওয়েকেই দেখুন। আউট হওয়ার হতাশায় ব্যাটে ঘুষি মেরে বসলেন। 

দল ফাইনাল খেলার পথে পিছিয়ে গেল কি না, এমন ভাবনা থেকেই হয়তো। ফাইনালটা খুব করে খেলতে চেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। নিউজিল্যান্ড ফাইনালে গেছে ঠিকই। কিন্তু আবেগের সেই ঘুষিটাই যে তার কাল হলো! আঙ্গুল ভেঙে গিয়েছে ঘুষিতে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফাইনালটা তাই খেলা হচ্ছে না তার।

Dhaka Post
কনওয়ের সেই ঘুষি

***

আপনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। কল্পনা আপনার পছন্দ। আপনি হয়তো সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। লাইফ ইজ বিউটিফুল সিনেমাটা আপনার খুব প্রিয়। আপনাকে বেঁচে থাকতে শেখায় যেটা। অথবা শশাঙ্ক রেডেম্পশন আপনাকে মুগ্ধ করে। 

ঘোর লাগিয়ে দিয়ে যায়। আপনি বুঝতে শিখেন, পরিশ্রম আপনাকে শেষ অঙ্কে পৌঁছে দেবে। আপনি কি অ্যান্ডিকে জীবনের মঞ্চেও খুঁজে ফেরেন? আপনার প্রিয় খেলা ক্রিকেটেও কাউকে পেতে চান? তাহলে অবশ্যই কেন উইলিয়ামসনকে বেছে নিতে হবে আপনার।

Dhaka Post

নিউজিল্যান্ড সবসময়ই ‘মোটামুটি’ ভালো দল। কিন্তু এই দলটাকে একটু একটু করে সুঁতোয় বেঁধেছেন কেন। নিজের পরিশ্রমে সত্যিকারের দল হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ক্রিকেটে নিজেদের আলাদা ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠিত করিয়েছেন। সেমিফাইনালটাই দেখুন।

গাপটিল আউট হয়ে গেছেন, বড় মঞ্চে বরাবর ব্যর্থ হলেও দলের সবচেয়ে বড় হিটারদের একজন তিনিই। অধিনায়ক উইলিয়ামসন দলের সবচেয়ে বড় আশা-হতাশ করলেন তিনিও। গ্লেন ফিলিপসকে নিয়ে স্বপ্নটা অনেক বড়-তিনি বোধ হয় বুঝে উঠতে পারেননি। আউট হলেন। তাতে কী?

দৃশ্যপটে হাজির হলেন জিমি নিশাম। দলকে জেতালেন ড্যারিল মিচেল। ছোটবেলায় রাগবি খেলতে চাওয়া এই কিউই গত পাঁচ বছরে হয়ে ওঠেছিলেন ফিনিশার। অন্তত নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া টুর্নামেন্টে তার চেয়ে বেশি ছক্কা আর কেউই মারতে পারেননি।

Dhaka Post
নিউজিল্যান্ডকে ফাইনালে তুলে ড্যারিল মিচেল

এই বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে তাকে হঠাৎ ওপেনার বানিয়ে দেওয়া হলো। মিচেল না করলেন না। পছন্দ হলো কোচ ও অধিনায়কের। ঘরোয়া ক্রিকেটেও কখনো ওপেন না করা মিচেল এখন নামবেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে, ওপেনার হিসেবেই হয়তো। দলের জন্য কোনটা জরুরি-সেটা মিচেল কিংবা কেনের জন্যও। জীবন আপনাকে এভাবেই চমকে দেয়। উইলিয়ামসনের দলটার মতো করে।

***

অস্ট্রেলিয়ার গল্পটা আলাদা। দাপুটে, খ্যাপাটে, আক্রমণাত্মক অজিদের পুরোনো গল্প শোনা যায় অনেক। সে অনুযায়ী এখন দেখা মেলে কম। ম্যাথু ওয়েড কি শুনে ফেলেছিলেন এমন কিছু? নইলে এমনভাবে মারতে শুরু করলেন কেন!

গ্লেন ম্যাক্সওয়েল রিভার্স সুইপ করেছিলেন। তার জন্য শটটা সাধারণ। কিন্তু বলটা এবার গেল হারিস রউফের হাতে। শাদাব খান নিজের বোলিং শেষ করলেন ৪-০-২৬-৪ ফিগার নিয়ে। সেমিফাইনালের সেরা বোলিংটা করলেন তিনি। অন্য যেকোনো দিন হলে, ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু দিনটা যে ম্যাথু ওয়েডের হওয়ার কথা ছিল!

তবে তার ফিনিশার হওয়ার কথা ছিল না। তিনি বিগ ব্যাশে ওপেন করতেন। ২০১৮ সাল থেকে খেলা ২৯ ইনিংসে ১১৬৭ রান করেছিলেন। দেড়শর ওপর স্ট্রাইক রেটে। তার শেষদিকে ভালো ব্যাটিংয়ের অভিজ্ঞতা খুব একটা ছিল না। বিশেষত টি-টোয়েন্টিতে।

Dhaka Post
যে এক স্কুপে পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দিয়েছিলেন ওয়েড

কিন্তু তিনি যে অস্ট্রেলিয়ান। সেমিফাইনালে কখনো না হারা দলের প্রতিনিধি। ওয়েড তাই হারতে পারেননি। শহরে আবির্ভাব হয় নতুন ফিনিশারের। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যর্থ স্কুপ শটটাও তার ব্যাটে এমনভাবে লাগে, মুগ্ধ করে ফেলে সবাইকে।

কীভাবে হাল ছাড়তে হয় না, বুক চিতিয়ে জয়ের চেষ্টা করতে হয়; অস্ট্রেলিয়া সেটিই দেখায় আরেকবার। ওয়েড কিংবা স্টয়নিস যেই হোন না কেন, তারা তো আদতে প্রতিনিধিত্ব করেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা অজিদের ব্র্যান্ড অব ক্রিকেটেরই।

***

দুটো আলাদা ধরনের দল। দুটো আলাদা ব্র্যান্ডের ক্রিকেট। দুটো দলের আলাদা ধরনের ঐতিহ্য। লক্ষ্যটা অবশ্য এক, প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়। ক্রিকেট তাদের কাছে আলাদা অর্থবহ করে। অস্ট্রেলিয়ার শো কেস ভর্তি শিরোপা, নিউজিল্যান্ডের কেবল টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ।

নিউজিল্যান্ডকে ক্রিকেট কাঁদায় লর্ডসে, ধারাভাষ্যকার ইয়ান স্মিথের ভাষায় যা ‘অ্যাগনি’। হাসায় দুবাই, সেই ইংল্যান্ডকে হারিয়েই ফাইনালে ওঠে তারা। কিন্তু জিমি নিশাম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন না। নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকেন। কেন? টুইটারে তিনি লিখেন, ‘কাজটা তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি...’

অতিরিক্ত আবেগের উচ্ছ্বাসে ভাসে না অস্ট্রেলিয়াও। অফ ফর্মে থাকলেও, টানা সিরিজ হারের ধকল থাকলেও। তারা জানে- বিশ্বমঞ্চটা তাদের জন্য। এখানে তাদের হাসতেই হবে। মাইক হাসি হাসান কিংবা ওয়েড। হাসতে তাদের হবেই।

নিউজিল্যান্ডও বিশ্বাস করে, কান্নাটা মুছতে হবে তাদের। গত কয়েক বছরে তিন ফরম্যাটের সবচেয়ে ভালো দলটা যে তারাই। দল হিসেবে কী করে খেলতে হয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কীভাবে ফিরতে হয়, নিউজিল্যান্ডের চেয়ে ভালো সেটা আর কেইবা জানে!

দুই দলের দুই রকমের পথচলা। তবে যেভাবে তারা ফিরে আসার গল্প লিখেছে বারবার। বিশ্বকাপ ফাইনালে তাই জমজমাট লড়াইয়ের অপেক্ষা করতেই পারেন যে কেউ। ক্রিকেট আপনাকে আবেগে ভাসায়, বিশ্বকাপ ডোবায় রোমাঞ্চের চোরাবালিতে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালও নিশ্চয়ই হতাশ করবে না।

জিমি নিশাম চাইলে আরেকটি টুইট করে খেলাটা দেখার আহ্বান জানাতে পারেন এখন, ‘বাচ্চারা, তোমরা ক্রিকেট দেখো। ক্রিকেট তোমাদের খলনায়ক বানাবে, নায়ক বানানোর দায়িত্বও নেবে। হাসাবে-কাঁদাবে, তোমাকে কিন্তু রোমাঞ্চেও ডুবাবে। গ্লোরিয়াস গেম অফ আনসার্টেনিটি তাই যতটা পারো- উপভোগ করো। বড়জোর হারবে। এরপর কিন্তু আবার জয়ের সুযোগটাও আছে; জীবনের মতো করে।’

এমএইচ/এনইউ

Link copied