‘স্মার্ট ক্রীড়াঙ্গন’: সমন্বিত পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন

Dhaka Post Desk

লে. জেনা. মো. মইনুল ইসলাম (অব.)

১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০২:২৮ পিএম


‘স্মার্ট ক্রীড়াঙ্গন’: সমন্বিত পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন

বাংলাদেশে সার্বিক খেলার মানোন্নয়ন এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফলতা অর্জন করতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে সমন্বিতভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই পরিকল্পনার অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করা একান্ত অপরিহার্য। খেলাধুলার মানোন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধনে একটি সমন্বয়কারী কমিটি গঠন অপরিহার্য। এই কমিটির কাজ হবে আগামী ২০৪০ সালকে টার্গেট করে বাংলাদেশের খেলাধুলার উন্নয়নে ভিশন, মিশন, বাস্তবায়ন ধাপ ও কর্মপদ্ধতি উল্লেখপূর্বক দীর্ঘমেয়াদী খসড়া পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। এই পরিকল্পনা প্রণয়নে উল্লেখিত সকল মন্ত্রণালয় ও সংস্থার নিজ নিজ সক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি। একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় ধাপে ধাপে খেলাধুলার ‘টেকসই উন্নয়নই’ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

খেলাধুলা উন্নয়নে অর্থ সহায়তা যোগান-

গত বছর আয়োজিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া দিবসে বাংলাদেশের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘সবাই মিলে খেলা করি, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ি’। সমাজের শিশু ও যুবকরাই হচ্ছে বাংলাদেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। বিগত এক যুগে বাংলাদেশের বিভিন্ন খেলাধুলার মান উন্নত হয়েছে এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের খেলোয়াড়গণ সফলতা অর্জন করেছে। তবে মহান স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে হলেও ‘অলিম্পিক গেমস’ এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গেমস আমাদের খেলোয়ারদের কৃতিত্ব অর্জনের হার আমাদের জনসংখ্যার (বাংলাদেশের যুব জনসংখ্যার হার প্রায় ৩৫%) তুলনায় খুবই নগন্য। 

গুটিকয়েক ফেডারেশন বা বোর্ড ব্যতীত বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্রীড়া ফেডারেশনের নিজস্ব কোনো আয় নাই বিধায় তারা সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। যুব সমাজকে খেলাধুলায় আগ্রহী করলে, লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের শারীরিক সক্ষমতা এবং মানবিক গুণাবলি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। তবে অর্থ সহায়তার বিষয়টিকে ‘সরকারি অনুদান’ হিসেবে না হয়ে, দেশের যুব সমাজের উন্নয়নের জন্য জাতীয় রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটের অধীনে বিভিন্ন ফেডারেশনের প্রশাসনিক ও খেলাধূলা পরিচালনা কর্মকান্ডের জন্য অর্থ বরাদ্দ অর্ন্তভুক্তকরণ শ্রেয় হবে। যখনই ফেডারেশনকে ‘অর্থ আয়ের স্থায়ী বিকল্প উৎস অনুসন্ধান করতে বলা হবে’, তখনই দেখা যাবে, বেশী মূল্যে দোকান ভাড়া দিয়ে কর্তৃপক্ষকে কম ভাড়া দেখানো, মার্কেটের বিভিন্ন খোলা স্থানে মালপত্র রাখার অনুমতি দিয়ে অবৈধ টাকা উপার্জন এবং কিছু ক্লাব কর্তৃক অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনার বিষয়টিও পরিলক্ষিত হয়েছে। ক্রীড়া যদি ব্যবসায় পরিণত হয়, তখন সেটা ক্রীড়া থাকে না। এছাড়াও এজন্য নিপুণ ক্রীড়াবিদদের খেলা হতে অবসর নেওয়ার পরে ভবিষ্যতে সম্মানজনক আয়ের উৎস নিশ্চিত করতে হবে।

সাংগঠনিকভাবে বাংলাদেশে মোট ৫৩টি ফেডারেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন খেলাধুলার ও প্রতিযোগিতার কার্যক্রম চলমান। তবে খেলাধুলার প্রসার ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও অবকাঠামোর অপ্রতুলতা বিদ্যমান। বিভিন্ন ফেডারেশনসমূহ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এবং বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন হতে খেলাধুলার অনুশীলন ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ প্রাপ্তি হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। ফেডারেশন সমূহ নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকের সহায়তা পেলেও তাও যথেষ্ঠ হয় না। উপরোক্ত বিষয় সমূহ বিবেচনা করে বাংলাদেশের শিশু ও যুব সমাজের পুরুষ এবং মহিলাদের (সুবিধাবঞ্চিত ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্নব্যক্তিবর্গসহ) বিভিন্ন খেলাধুলায় অধিকহারে অংশগ্রহণে আগ্রহী/উৎসাহী করে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার জন্য নিম্নে বর্ণিত বিষয়সমূহ গুরুত্বপূর্ণ।

(১) রাজস্ব বাজেট বরাদ্দ- বিভিন্ন খেলাধুলার প্রসার, প্রশিক্ষণ, আন্তঃজেলা/আন্তঃবিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য সরকারের বাৎসরিক ও পঞ্চবার্ষিকী বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা। এই প্রক্রিয়ায় ফেডারেশন সমূহ দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, তা বাস্তবায়ন করতে পারবে।

(২) উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ-খেলাধুলার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় স্থাপনা এবং খেলাধুলার জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ক্যাপিটাল সামগ্রী দেশের উন্নয়ন বাজেট হতে বরাদ্দের ব্যবস্থা প্রচলন করা। যাতে ফেডারেশন সমূহ দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, তা বাস্তবায়ন করতে পারবে।

(৩) প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ হতে খেলাধুলার খাতে বরাদ্দ- বাংলাদেশের পরিচালিত আইন অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ওপর নির্ভর করে। অর্থের একটি নির্দিষ্ট হারের অর্থ খেলাধুলার জন্য প্রদান করতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ একটি নীতিমালা প্রণয়ন করত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে খেলাধুলায় উন্নয়নের ব্যয়ের জন্য গ্রহণ করবেন এবং একই নীতিমালার অধীনে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্যের সঙ্গে অংশগ্রহণ করা বিভিন্ন ফেডারেশন ও ক্রীড়া সমিতিকে অর্থ হতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর বরাদ্দ করবেন।

উপরোক্ত কর্মকান্ড নিশ্চিতকল্পে আগামীতে কমপক্ষে ৪টি অলিম্পিক গেমস (২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক, ২০২৮ সালের লস এঞ্জেলস অলিম্পিক, ২০৩২ ব্রিসবেন অলিম্পিক, ২০৩৬ অলিম্পিক এবং ২০৪০ অলিম্পিক) যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করার জন্য, সম্ভাবনাময় ব্যক্তি পর্যায়ের খেলা সমূহের মানন্নোয়নের জন্য পরিকল্পনা ও দীর্ঘ মেয়াদী হিসাবে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। এই পরিকল্পনায় খেলার সাথে সম্পর্কিত খেলোয়াড়, কোচ/প্রশিক্ষক, জাজ/রেফারী, স্পোর্টস মেডিসিনের চিকিৎসক, ফিজিও, খাদ্য তত্ত্ববিদ, মনোবিজ্ঞানী, মাঠ রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যক্তিবর্গ, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গদের মাসিক সম্মানী দেয়ার বিষয়কে দীর্ঘমেয়াদী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এছাড়াও বিভিন্ন খেলা বা গেমস আয়োজন করার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্নজেলায় প্রাপ্ত বিভিন্ন ষ্টেডিয়ামকে ব্যবহার করতে হবে, যাতে খেলা আয়োজনের কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা ঢাকার বাইরেও গড়ে উঠে। এতে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠন, ষ্টেডিয়াম ও খেলা সমূহ উজ্জীবিত হবে।

বিভিন্ন গেমস-এর অর্জিত সফলতার মুল্যায়ন।

বঙ্গবন্ধু ৯ম বাংলাদেশ গেমস ২০২০ - এই খেলার পদক তালিকায় প্রতীয়মান হয় যে, মোট ৩৬২টি সংস্থা/দল/ক্লাবের মধ্যে হতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (ক্রমিক নং ১ হতে ৮ পর্যন্ত) মোট ৮টি দল মোট ৩৮৩টি স্বর্ণ পদকের মধ্যে ৩৫৪টি (৯২%), ৩৮০টি রৌপ্য পদকের মধ্যে ২৮৩টি (৭৪%), ৫০০টি ব্রোঞ্জ পদকের মধ্যে ২৭৩টি (৫৫%) এবং মোট ১২৬৩টি পদের মধ্যে ৯১০টি (৭২%) পদক প্রাপ্ত হন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, মাত্র ২% সংস্থা/দল/ক্লাব মোট পদক সমূহের ৭২% পদক লাভ করেছে। পদক প্রাপ্তির তালিকায় আরও প্রতীয়মান হয় যে, ৩৬২টি দলের মধ্যে ক্রমিক নং ১৪৩ হতে ৩৬২ পর্যন্ত মোট ২১৯টি (৬১%) সংস্থা/দল/ক্লাব কোনো পদক প্রাপ্ত হয়নি।

১৩তম সাউথ এশিয়ান গেমস, নেপাল - মোট ২৫টি ডিসিপ্লিনে ৪৬২ জন খেলোয়াড়, ১৩৩ জন কোচ/ম্যানেজার এবং ১৫ জন কর্মকর্তাসহ ৬১০ জনের বাংলাদেশ দল অংশগ্রহণ করে। এই প্রতিযোগিতায় ২৫টি ডিসিপ্লিনের মধ্যে ১৮টি ডিসিপ্লিনে (৭২%) ছিল ব্যক্তি পর্যায়ের নন-কন্টাক্ট গেমস এবং ৭টি ডিসিপ্লিনে (২৮%) ছিল দলগত কন্টাক্ট গেমস। এই খেলায় ১৮টি ননকন্টাক্ট গেমস-এ অর্জিত হয় ১৭টি স্বর্ণ, ৩২টি রৌপ্য, ৮০টি ব্রোঞ্জ পদক সহ মোট ১২৯টি পদক। অপরদিকে ৭টি কন্টাক্ট গেমস্-এ অর্জিত হয় ২টি স্বর্ণ, ১টি রৌপ্য ও ৫টি ব্রোঞ্জ পদক সহ মোট ৮টি পদক। মোট ১৩৭টি পদকের মধ্যে নন-কন্টাক্ট গেমস-এ পদকের অর্জন ৯৪%। অপরদিকে কন্টাক্ট গেমস-এ পদকের অর্জন মাত্র ৬%। এতে প্রতিয়মান হয় যে, সাউথ এশিয়ান, এশিয়ান ও অলিম্পিক গেমস-এ ননকন্টাক্ট গেমস সমূহের সম্ভাবনা কন্টাক্ট গেমস-এর তুলনায় যোজন সম্মুখে এগিয়ে আছে।

১৩তম এশিয়ান গেমসে পদক প্রাপ্তিতে বিভিন্ন দেশের অবস্থান-

dhakapost

টোকিও অলিম্পিক ২০২০- ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পরেও মাত্র ১টি খেলায় যোগ্যতা অর্জন করে এবং অপর ৩টি খেলায় কোটার মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছে। খেলার মানের এই রুগ্ন অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণের জন্য ১টি মাত্র পথ, খেলার উন্নয়ন ও উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় খেলার সুবিধাদি স্থাপন ও বিবিধ ব্যয় বহনের জন্য জাতীয় বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা। এছাড়া সিএসআর-এর অধীনে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা ও কর্পোরেশন সমূহের ক্রীড়ার জন্য অর্থ ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনায়ন, নিপুন খেলোয়াড়দের জন্য ভবিষ্যত অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থার বিষয়টিও প্রনিধান যোগ্য।

বাংলাদেশ গেমস-এর আয়োজন-  বিগত ৯ম বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমস-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল তৃণমূল পর্যায়ে খেলাধুলাকে বিস্তৃত করা, শিশু কিশোরদের খেলাধুলায় উৎসাহী করা এবং প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে খুজে বের করা। প্রতি ৪ বছর বাংলাদেশ গেমস আয়োজন করার স্থলে ৩ বছরে ১ বার বাংলাদেশ গেমস আয়োজন করা এবং এই ধরণের গেমস-এ প্রটোকল ও আনুষ্ঠানিকতা, জাঁকজমকপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, আতশবাজি পোড়ানো এবং খেলার সাথে সম্পর্কহীন বিশাল প্রটোকলের আয়োজন পরিহার করে, খেলা আয়োজনে অর্থ ব্যয় করাই কাম্য। এতে আয়োজনকারীদের মনোনিবেশ থাকবে খেলার আয়োজন নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে নয়।

১ম বারের মত যুব গেমস আয়োজন করায় এতে সকল ডিসিপ্লিনে প্রতিভাবান খেলোয়ারদের চিহ্নিত করার সুযোগ হয়েছে। যুব গেমসও ৩ বছরে ১ বার আয়োজন করা যেতে পারে। এতে করে ১ বছর যুব গেমস, অপর ১ বছর বাংলাদেশ গেমস এবং ২ বছর থাকবে অলিম্পিকে অংশগ্রহনের জন্য প্রস্তুতি। প্রতি বছরেই প্রতিভা অন্বেষনের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। এতে বাংলাদেশ অলিম্পিকে খেলার জন্য বিওএ কর্তৃক নির্ধারিত খেলাধুলায় সমূহে প্রাণ ফিরে আসবে।

সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করণ

ফেডারেশনসমূহের কাউন্সিলর নিয়োগ পদ্ধতি- প্রায় সকল ফেডারেশনই বিভিন্ন ক্লাবের দল সমূহ হতে ১জন করে প্রতিনিধি তাদের কাউন্সিলর হিসাবে মনোনীত করেন। এই সকল কাউন্সিলরগণ হতে ফেডারেশনের কার্যনির্বাহীর কমিটির বিভিন্ন পদে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ৯ম বাংলাদেশ গেমস ২০২০-এর পদক অর্জনের তালিকা পর্যবেক্ষণ করলে প্রতিয়মান হয় যে, মোট ৩৬২টি সংস্থা/দল/ক্লাবের মধ্যে হতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (ক্রমিক নং ১ হতে ৮ পর্যন্ত) মোট ৮টি দল মোট ৩৮৩টি স্বর্ণ পদকের মধ্যে ৩৫৪টি (৯২%), ৩৮০টি রৌপ্য পদকের মধ্যে ২৮৩টি (৭৪%), ৫০০টি ব্রোঞ্জ পদকের মধ্যে ২৭৩টি (৫৫%) এবং মোট ১২৬৩টি পদের মধ্যে ৯১০টি (৭২%) পদক প্রাপ্ত হন। এতে প্রতিয়মান হয় যে, মাত্র ২% সংস্থা/দল/ক্লাব মোট পদক সমূহের ৭২% পদক লাভ করেছে। পদক প্রাপ্তির তালিকায় আরও প্রতিয়মান হয় যে, ৩৬২টি দলের মধ্যে ক্রমিক নং ১৪৩ হতে ৩৬২ পর্যন্ত মোট ২১৯টি (৬১%) সংস্থা/দল/ক্লাব কোন পদক প্রাপ্ত হয়নি। এই তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের বিবেচনা করতে হবে, “বিভিন্ন সংস্থা/দল/ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটিকে তাদের খেলার ডিসিপ্লিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কোন অবস্থানে আছে তার মানদন্ড নির্দিষ্ট করে তাদেরকে বিভিন্ন ধাপে (১/২/৩ ডিভিশন) স্বীকৃতি দেয়ার মানদন্ড নির্ধারণ করতে হবে। এই বিষয়টি নিশ্চিত না করতে পারলে নামসর্বস্ব গঠিত সংস্থা/দল/ক্লাব সমূহ কেবল বিভিন্ন পর্যায়ে কাউন্সিলার/অন্যান্য পদ মর্যাদায় অবস্থান পাওয়ার জন্য সংগঠিত হলে, তাদের পক্ষে খেলাধুলার উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে না। একটি নির্ধারিত মানে সফলতা অর্জন করতে পারলে এবং তা ধরে রাখতে পারলে সংস্থা/দল/ক্লাব সমূহকে ক্রমান্বয়ে নির্ধারিত ধাপে (১/২/৩ ডিভিশন) স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে।

বিভিন্ন বাহিনী হতে ফেডারেশনের “কার্যনির্বাহী কমিটিতে” নিয়োগ- বাংলাদেশের খেলাধুলায় প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন বাহিনী সমূহের অবদান বিগত বঙ্গবন্ধু নবম বাংলাদেশ গেমস ২০২০ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, সেনাবাহিনী, নে․বাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ পুলিশ (সকলেরই ম্যাডেল প্রাপ্তি ৫০-এর উর্দ্ধ হতে ২৭০ পর্যন্ত)। উপরোক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহ, সরকারি বাজেটের নির্দিষ্ট খাত হতে অর্থ ব্যয় করে বাহিনী সদস্যদের দক্ষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে তোলেন এবং রক্ষণাবেক্ষণ করেন। কিন্তু অতিব দুঃখের বিষয় যে,উপরোক্ত সংগঠন সমূহ হতে বর্তমানের প্রচলন অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে কার্যনির্বাহী কমিটিতে নিয়োগ দেয়া হয় না। এক্ষেত্রে অযুহাত থাকে যে, এই সকল বাহিনীর অফিসারগণ যেহেতু প্রায়শই বদলী হয়ে যান, সে জন্য তাদেরকে কার্যনির্বাহী কমিটিতে নিয়োগ দেয়া হয় না। বাংলাদেশের খেলাধুলার উন্নয়নে ওপরে বর্ণিত যে সকল সংস্থা, যে সকল খেলাধুলায় সফলতা লাভ করেছেন সে সকল ফেডারেশনে কমপক্ষে ১জন সহ সভাপতি, ১জন সহকারী সাধারণ সম্পদক এবং ৪ জনকে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন সমূহের গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করার জন্য সুপারিশ করছি। উল্লেখ্য যে, এই সকল পদের অফিসার/ কর্মকর্তাগণ সরকারি আদেশে বদলী হয়ে গেলেও তার স্থানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান হতে নির্ধারিত ব্যক্তিকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পদে বদলী হিসেবে আগত অফিসারকে/ব্যক্তিকে একই দায়িত্ব অর্পন করা যেতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও বিকাশ- যে কোন খেলোয়াড়, কোচের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তার দক্ষতার বিকাশ করে থাকে। তবে খেলোয়াড় কর্তৃক অর্জিত খেলার টেকনিক্যাল দক্ষতা যথাযথ প্রয়োগের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন ফেডারেশন সমূহ স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে স্বল্পমেয়াদি/দীর্ঘমেয়াদি ভাবে মানষিক স্বাস্থ্য গঠনে সাইক্লোলোজিস্ট নিয়োগ করে থাকে। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন ফেডারেশনের খেলাধুলার মান্নোয়নকল্পে তাদের খেলোয়ারদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি সঠিকভাবে হচ্ছে কি না বা তাদের কোন সহায়তা প্রয়োজন রয়েছে কি না তা নির্ধারণের জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়/বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন-এর অধীনে ও অর্থায়নে একটি যোগ্য এবং দক্ষ সাইক্লোলোজিস্ট দল গঠন প্রয়োজন।

খাদ্য তত্ত্ববিদ-খেলোয়ারদের নিজ নিজ ডিসিপ্লিনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্ঠিমানের খাদ্য গ্রহণের বিষয়টির উপরেও গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া বিদেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য পরিবর্তিত খাদ্যাভাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়টিও খাদ্য তালিকায় গুরুত্ব পাবে। এই বিষয়ে খেলোয়ারদের খাদ্য মান ও বিভিন্ন মৌসুমে প্রাপ্ত শাকসবজি প্রাপ্তি বিবেচনা করে দৈনিক খাদ্য তালিকাকে উপযোগী করার জন্য ফেডারেশন সমূহ কর্তৃক গ্রহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা করে তাদের সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ ও সহযোগিতা প্রদান করতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়/ বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন-এর অধীনে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়ে একটি “স্পোটর্স খাদ্য তত্ত্ববিদ টিম” গঠন করা।

স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ- খেলোয়ারদের নিজ নিজ ডিসিপ্লিনের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখার জন্য স্পোর্টস্ মেডিসিন (ফিজিক্যাল মেডিসিন, ফিজিওথেরাপি, ম্যাসেজথেরাপি ইত্যাদি) বিষয়ে বিভিন্ন ফেডারেশন সমূহ কর্তৃক গ্রহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা করে তাদের সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ ও সহযোগিতা প্রদান করতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়/ বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন-এর অধীনে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়ে একটি “স্পোর্টস মেডিসিন” টিম গঠন করা।

পারফরম্যান্স উৎসাহ ভাতা চালুকরণ- বিভিন্ন দেশীয় প্রতিযোগিতা ও গেমসে, আঞ্চলিক/আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়/গেমসে ১ম হতে ৪র্থ স্থান অর্জনকারী এবং অলিম্পিকে যোগ্যতা অর্জন করে যোগদান করে প্রতিযোগিতায় ৯ম ও তার উর্দ্ধে ফলাফল অর্জন করতে পারলে উৎসাহ ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা চালু করা। এছাড়াও দেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় রেকর্ড অর্জনকারীর জন্য উৎসাহ ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা চালুকরণ। নতুন রেকর্ড স্থাপন করতে পারলে নতুন জন উৎসাহ ভাতা পাবে। এই সম্পর্কে কোন কোন ইভেন্টে উৎসাহ ভাতা প্রদান করা হবে, কি পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হবে, ভাতা প্রদানের সময়কাল কি পর্যায়ে হবে এবং অর্থের উৎস কি হবে এই বিষয়ে সমন্বিত বিস্তারিত নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে।

খেলোয়াড়দের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ-পূর্বে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা সংস্থা সমূহ বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের ক্লাব রক্ষণাবেক্ষন করতেন। সেখানে খেলোয়ারগণ চাকুরী সুবিধা লাভ করতেন। তবে একটি নির্ধারিত মানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোন খেলোয়ার তার মান ধরে রাখতে পারলে তার জন্য প্রতি মাসের জন্য নির্ধারিত ভাতা বা এককালীন অর্থ “পারফরমেন্স ইনসেন্টিভ” হিসাবে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনা অপরিহার্য। এজন্য নিপুণ ক্রীড়াবিদদের খেলা হতে অবসর নেওয়ার পরে ভবিষ্যতে নির্ধারিত আয়ের উৎস নিশ্চিত করতে হবে।

খেলোয়াড়দের স্বপরিবারে বসবাসের সুযোগ প্রদান- বিভিন্ন নন-কন্ট্রাক্ট খেলাধুলায় সুনিপণ/কৃতি খেলোয়ারগণ বিবাহ করার পর পারিবারিক কারণেই স্বপরিবারে বসবাস করতে আগ্রহী থাকেন। অপরদিকে খেলোয়ারদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও বজায় রাখতে তাদেরকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের আশেপাশে বসবাস (প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য) করাই বাঞ্চনীয়। খেলোয়ারের দক্ষতা ব্যবহার করার জন্য তাকে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নিকটে আলাদা পারিবারিক বাসস্থান দেওয়ার জন্য প্রায় সকল ফেডারেশনের আর্থিক সংগতি থাকে না। বিষয়টি বিবেচনা করে দেশের জন্য আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজয় অর্জন করার জন্য দক্ষ খেলোয়ারদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নিকটে স্বপরিবারে বসবাস (প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য) করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদানের নীতিমালা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়/ বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রণয়ন করা অপরিহার্য।

পরিশেষে বলা যায়, ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশকে খেলাধুলায় বিশ্ব দরবারে আরো স্মার্টভাবে অবদান রাখতে খেলাধুলার মান ও এর সাথে সম্পর্কিত সংগঠনের মানোন্নোয়ন একান্ত অপরিহার্য। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুব সমাজকে এগিয়ে যেতে হবে শিক্ষায়, শারীরিক সক্ষমতায় ও বিভিন্ন সাংগঠনিক দক্ষতায়। খেলার মাধ্যমে বিনোদন গড়ে তুলতে পারলে আদর্শ নাগরিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। 

লেখক

জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগঠক
সভাপতি, বাংলাদেশ আরচ্যারী ফেডারেশন
সহ সভাপতি, বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন

এজেড/এফআই

Link copied