সাজেকের বুকে এক টুকরো লুসাই গ্রাম
গ্রাম শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামেন ভেসে উঠে দীগন্তজোড়া সবুজ ধানক্ষেত, মেঠো পথ, বাঁধানো পুকুর ঘাট আর বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের সব গ্রামই তেমন নয়। এমন কিছু গ্রাম রয়েছে যেখানে গেলে চোখে পড়বে গাছবাড়ি, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ আর মাচাং ঘর।
বলছি মেঘের রাজ্য খ্যাত সাজেক ভ্যালির ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রামের কথা। পাহাড়ে বসবাসরত অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী লুসাইদের জীবনযাত্রা ও কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে তুলে ধরে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম এই গ্রাম।
মেঘের রাজ্য হিসেবে সাজেক ভ্যালির খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। পাহাড়ের বুকে গড়ে উঠা ছোট্ট এই নগরী যেন কল্পনার রাজ্যের কোন কল্পনগরী। প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের কাছে সাজেক রয়েছে পছন্দের শীর্ষে। তাই সারাবছরই এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।
সাজেক মূলত লুসাই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। সাজেক পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে উঠার আগে এখানে লুসাই জনগোষ্ঠীদের বসবাসের আধিক্য ছিল। সেই লুসাইদের জীবনযাত্রা, পোশাক, কৃষ্টি, সংস্কৃতিসহ তাদের জীবনধারাকে সাজেকে আগত পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার জন্যই তৈরি করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রাম।
সাজেক রুইলুই পাড়া হ্যালিপ্যাডের খুব কাছেই ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রামের অবস্থান। ৩০ টাকা প্রবেশমূল্য দিয়েই প্রবেশ করা যায় এই গ্রামে। যদি লুসাইদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে প্রবেশ করতে চান তখন ফি হয় ১০০ টাকা। এই গ্রামে দাঁড়িয়েই উপভোগ করা যায় দূরের লুসাই পাহাড়ের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য। লুসাই গ্রামের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই আপনাকে স্বাগত জানাবে সাজেকের একমাত্র ‘ট্রি-হাউস’ বা গাছবাড়ি।
গাছবাড়িতে উঠে অনেক দূরের পাহাড় পর্যন্ত দেখা যায়। গাছবাড়ি থেকে নেমেই সামনে পড়বে দোকানদার বিহীন একটি দোকান । যেখান থেকে পাহাড়ি ফলমূল নিয়ে মূল্য রেখে যেতে পারবেন। নিচের দিকে যেতে থাকলে সামনে আরো কিছু মাচাং ঘর পড়বে। যেখানে লুসাইদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। গ্রামের একেবারে শেষে রয়েছে একটি মুক্তমঞ্চ। তবে মঞ্চটি লুসাইদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী তৈরি করা। মঞ্চের সামনেই রয়েছে দর্শকদের বসার স্থান। বড় বড় গাছের গুড়ি দিয়ে গ্যালারির আদলে তৈরি করা এই বসার স্থান নজর কাড়বে যে কারোরই।
মুক্তমঞ্চের কিছুটা পাশেই রয়েছে একটি বড় মাচাং ঘর, যার নাম জলবুক। জলবুক এমন একটি স্থান যেখানে সকল অবিবাহিত লুসাই পুরুষদের প্রথাগত আবাসিক থাকার জায়গা। যা গ্রামের নিরাপত্তার স্বার্থে রাত্রিযাপনের জন্য ব্যবহৃত হতো। এখান থেকে তারা কুস্তি, শিক্ষা, শিকার, বিনোদন, ব্যক্তিগত দক্ষতা, নিরাপত্তা শিক্ষা এবং গ্রাম সরকার ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ নিতেন।
১৫ বছরের বেশি হলেই জলবুকে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা হতো। নারী ও শিশুদের জলবুকের ভেতর প্রবেশের অনুমতি ছিলো না। ব্রিটিশ শাসন আমলে জলবুকের গুরুত্ব কমতে থাকে। প্রথাগত শিক্ষা ও খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দান শুরু হওয়ার পর থেকেই জলবুকের জৌলুস কমতে থাকে।
সাজেকে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে এই ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রাম সবসময় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। লুসাইদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক গায়ে চাপিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও লুসাইদের জীবনকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন পর্যটকরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে লুসাই গ্রামে বেড়াতে আসা পর্যটক তাসফিয়া বিনতে হাবিবা বলেন, সাজেক এবং লুসাই গ্রাম দুটোই খুব সুন্দর। যেহেতু এটি পাহাড়ি এলাকা এবং এখানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের বসবাস বেশি, এই লুসাই গ্রামের মাধ্যমে আমরা তাদের জীবনযাত্রা, পোশাক-পরিচ্ছেদ ও ঐতিহ্যকে অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারলাম।
আরেক পর্যটক কাইমুল ইসলাম বলেন, সাজেকের অন্যতম আকর্ষণ হলো এই লুসাই গ্রাম। যারা সাজেক বেড়াতে আসবেন আমি তাদের অবশ্যই এই লুসাই গ্রাম ভ্রমণের পরামর্শ দিব। আর লুসাইদের ঐতিহ্যবাহী এই পোশাকটা পড়ে খুবই ভালো লাগছে। এটি দেখতেও সুন্দর এবং পড়তেই খুবই আরামদায়ক।
ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রামের ম্যানেজিং পার্টনার সুলতান মাহমুদ বলেন, লুসাইদের কালচারকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার ধারণা থেকেই আমরা এটি তৈরি করেছি। এখানে এসে পর্যটকরা খুবই আনন্দ উপভোগ করেন। বিশেষ করে তারা লুসাইদের পোশাকটা পড়তে চান। লুসাইদের ঐতিহ্যগত যেসব বিষয় আছে আমরা তাঁর বেশিরভাগই এখানে সংযোজনের চেষ্টা করেছি। পর্যটকরা যাতে এখানে এসে ভালো একটা সময় কাটাতে পারেন সেজন্য আমরা আরো কিছু বিষয় সংযোজনের চেষ্টা করছি।
মিশু মল্লিক/