কৃষকের ফলনের ক্ষতি কমাবে ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনা
আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মাধ্যমে ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনা কৃষকদের ফলনের ক্ষতি প্রশমন করবে। পূর্বাভাসের মাধ্যমে দুর্যোগ সতর্কীকরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারলে কৃষকদের ক্ষতি কমিয়ে টেকসই উৎপাদন বজায় রাখা সম্ভব হবে। সোমবার (৩১ জানুয়ারি) সকালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘ইন্টিগ্রেটেড রাইস এডভাইজরি সিস্টেমস’ বিষয়ক শীর্ষক কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। ব্রির এগ্রোমেট এবং ক্রপ মডেলিং ল্যাবের উদ্যোগে জুম প্লাটফর্মে কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়।
ব্রির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধানগাছের কচি থোড় থেকে ফুল ফোটার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি হলে ধানে চিটা হয়ে যায়। অতিরিক্ত তাপ ও আর্দ্রতার কারণে গাছের ছত্রাক রোগ বাড়ে এবং একইভাবে পোকামাকড়ও বাড়িয়ে দেয়। কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি খরায় আক্রান্ত হচ্ছে। এদিকে প্রতিবছর হাজার হাজার একর পাকা ধান আকস্মিক বন্যায় নষ্ট হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মাধ্যমে কৃষকদের সতর্কীকরণ করা গেলে কৃষকের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব কমলা রঞ্জন দাস। বিশেষ অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান ও ব্রির পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা) ড. মো. আবু বকর ছিদ্দিক।
এতে এক্সপার্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন সিমিট-বাংলাদেশ’র কনসালটেন্ট ড. মইনুস সালাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এগ্রোমেট ইনফরমেশন সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক ড. শাহ কামাল খান, আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ এস এম কামরুল হাসান এবং রাইমস-বাংলাদেশ’র কান্ট্রি প্রোগ্রাম লিড রায়হানুল হক খান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ব্রি কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. ইসমাইল হোসেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান, প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ও কো-অর্ডিনেটর, ব্রি এগ্রোমেট ল্যাব।
ব্রির কৃষি আবহাওয়া এবং ক্রপ মডেলিং ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও মূল প্রবন্ধকার নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান জানান, আবহাওয়া পূর্বাভাস ভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শস্যের ফলন ৭-১০ শতাংশ বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস এবং মোট আয় ৩১-৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে এখন দেশের মাত্র ৫ শতাংশ ধান চাষি আবহাওয়া পূর্বাভাস ভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবা গ্রহণ করছেন। গবেষকদের দাবি পূর্বাভাস ভিত্তিক কৃষি পরামর্শ অনুযায়ী চাষাবাদ করলে ধানের ফলন কমপক্ষে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, যা জাতীয় খাদ্য ঝুড়িতে ০.১৭ মিলিয়ন টন ধান যোগ করবে। যদি আবহাওয়া পূর্বাভাস ভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবা পুরো ধান উৎপাদন ব্যবস্থায় সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এক্ষেত্রে এক টাকা বিনিয়োগে ৫১-৭৩ টাকা আয় হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব কমলা রঞ্জন দাস বলেন, বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকেরা ক্রমবর্ধমান জলবায়ু ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য হচ্ছে ধান, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি কৃষি সম্প্রদায়ের জীবিকার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তাই জাতীয় কৃষি নীতিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মাধ্যমে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য সতর্কীকরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ধানের ৬০ ভাগ ফলন নির্ভর করে সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর। ব্রি এগ্রোমেট ল্যাব কর্তৃক তৈরিকৃত ধান চাষাবাদ ও আবহাওয়া বিষয়ক পূর্বাভাস ও পরামর্শ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে কৃষকরা উপকৃত হবে এবং তা ধানের ফলন ও সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে এ ক্রমবর্ধমান চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর প্রভাব হ্রাস করে কৃষির উন্নয়নের জন্য জলবায়ু স্থিতিশীল কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ২০১৬ সালে কৃষি আবহাওয়া এবং ক্রপ মডেলিং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পূর্বাভাসের ডেটা প্রক্রিয়াকরণ, মূল্যায়ন এবং যাচাইকরণ সঙ্গে গবেষক, সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং কৃষকদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস ভিত্তিক ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও পরামর্শ সেবা প্রস্তুত এবং প্রচারের জন্য একটি ওয়েব-ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় প্ল্যাটফর্ম ‘ইন্টিগ্রেটেড রাইস অ্যাডভাইজরি সিস্টেম’ তৈরি করা হয়েছে। সেই প্লাটফর্মটি অবস্থান-নির্দিষ্ট আবহাওয়ার পূর্বাভাস, সঙ্গে সঙ্গে সেই সব বিভিন্ন অবস্থানের জন্য ধানের বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষকদের ইনপুটের মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ভিত্তিক ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সাপ্তাহিক বুলেটিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করছে এবং সেই বুলেটিনটি এক্সটেনশন অফিসিয়ালদের কাছে ইমেইলের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রচার করবে।
প্লাটফর্মটি ব্রি, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং ডিএইয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করবে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ধান উৎপাদনে কৃষি আবহাওয়া সংক্রান্ত পরামর্শমূলক পরিষেবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরবরাহের জন্য এগ্রোমেট ল্যাব, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরি করেছে, যার বাস্তবায়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
এ ল্যাবরেটরিটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জলবায়ু স্থিতিশীল ধান উৎপাদনের লক্ষ্যে ধান ফসল- আবহাওয়ার সম্পর্ক এবং ধান ফসলের পোকা-মাকড় ও রোগের সঙ্গে আবহাওয়ার সংবেদনশীলতা নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে কৃষক এবং সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে। প্রকল্পটি ব্রি এগ্রোমেট এবং ক্রপ মডেলিং ল্যাবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস-ভিত্তিক ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল।
এসএসএইচ