বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন

বৈশ্বিকভাবে খুব একটা ভালো নেই প্রবাল। ‌'জীবন্ত এই স্থাপত্য' তৈরি হয় যে প্রাণীর মাধ্যমে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তারা খুবই বিরূপ অবস্থায় রয়েছে। এরইমধ্যে প্রচুর সংখ্যায় তারা মারা যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে ক্ষতিকর নিঃসরণ কমানো না গেলে এই প্রাণীদের ভবিষ্যতই হুমকির মুখে পড়বে।

কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে প্রবাল বাঁচানোর আর কোনো পথ নেই। বরং সাম্প্রতিক দুটি গবেষণায় এটা পরিষ্কার করা হয়েছে যে, মানুষ যদি চেষ্টা করে উষ্ণ সমুদ্রে ঠিকই টিকে থাকবে প্রবাল প্রাচীর।

গবেষণা দুটির একটির প্রধান ও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির কনজারভেশন সায়েন্সের অধ্যাপক ম্যারি ডোনোভ্যান বলছেন, আমরা কিন্তু সত্যিই এ খবরটাকে একটা ভালো খবর বলে মনে করি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবটা প্রবালপ্রাচীরের ওপর খুব শক্তভাবে পড়েছে। আমরা বলছি মানুষের কারণে এ পরিস্থিতি দিনদিন খারাপ হচ্ছে, সঙ্গে আমরা এও বলছি যে আমরা চাইলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

প্রাথমিক পরিণতি হিসেবে প্রবালগুলো সাদাটে হয়ে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়াকে ব্লিচিং বলা হচ্ছে। যে প্রাণীটা এই প্রাচীর তৈরি করে সেই কোরাল পলিপসের বাস রঙিন শৈবালের সাথে, এদের থেকেই পলিপসের খাবার আসে। কিন্তু সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের কারণে পলিপগুলো তার সঙ্গী শৈবালকে আর সঙ্গে রাখছে না। ফলে প্রাচীরগুলো সাদাটে বর্ণ ধারণ করছে। যেসব প্রবালপ্রাচীরের অবস্থা তুলনামূলক ভালো থাকে তারা এ দুঃসময়টা কাটিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু পরিস্থিতি যদি আরও খারাপের দিকে যায় তখন পুরো প্রবালপ্রাচীরটির ধ্বংস হওয়া ঠেকানোর পথ থাকে না।

গেল সপ্তাহে সায়েন্সে প্রকাশিত ডোনোভ্যানের গবেষণা অনুযায়ী, এই ব্লিচিং প্রক্রিয়া আরও খারাপের দিকে যায় মূলত দুটি কারণে। একটি হলো দূষণ আরেকটি অতিরিক্ত মাছ ধরা। এর অর্থ হলো স্থানীয়ভাবে ঠিকঠাক পদক্ষেপ নেওয়া গেলে প্রবালপ্রাচীরগুলো তাপপ্রবাহের ধকলের অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

ব্লিচিং প্রক্রিয়াতে যে প্রবালপ্রাচীরগুলো বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে, দেখা যাচ্ছে সেগুলোর সাথে অতিরিক্ত পরিমাণে সামুদ্রিক শৈবালের যোগ ছিল। স্বাভাবিক অবস্থায় শৈবালগুলো রিফ মাছের কারণে বেশি বাড়তে পারে না। এই শৈবালগুলো থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বের হয়, যা সরাসরি প্রবালের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলে।

ডোনোভ্যান বলছেন, তাপমাত্রা প্রবালগুলোকে আসলেও প্রচুর চাপে ফেলে। প্রবালগুলোর জন্য প্রতিকূল এই পরিবেশে তার সঙ্গে যদি নতুন করে কিছু যুক্ত হয়, তবে সেটা আসলেই খুব খারাপ হয়।

অবাক করা বিষয় হলো এই ব্লিচিং প্রক্রিয়ার সাথে সজারুর মতো দেখতে সামুদ্রিক একটা প্রাণীরও সম্পর্ক আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় এই প্রাণীগুলো টিকে থাকে শৈবাল খেয়ে। কিন্তু যখন এদের ওপরের স্তরের খাদক মাছগুলোকে মানুষ বেশি শিকার করে ফেলে তখন ওই প্রাণীদের সংখ্যা বেড়ে যায়।

সজারুর মতো দেখতে সামুদ্রিক এই প্রাণীর প্রবালের ব্লিচিং প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্ক  রয়েছে

ডোনোভ্যান বলছেন, তো যখন এই প্রাণীগুলোর সংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়ে যায়, তখন তারা আসলে ভালোর চেয়ে বেশি খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খাবারের অভাবে পড়ে তারা, চারপাশে অন্য কিছু থাকে না, কেবল ওই একটি প্রাণীই। এ প্রাণীগুলোর আবার খুব শক্ত দাঁতও থাকে, আর তার শেষ পরিণতি হিসেবে শক্ত এই দাঁতই প্রবালগুলোর ক্ষয় হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তবে মানুষ নিজেদের ভুলগুলো সুধরে নিয়ে ক্ষতির পরিমাণ কমাতে পারে।

এখানে যেভাবে এগোনো যেতে পারে তা হলো যেসব মাছ বেঁচে থাকার জন্য শৈবালের ওপর নির্ভরশীল, সেই মাছগুলোকে স্থানীয়ভাবে রক্ষা করতে হবে। ডোনোভ্যান বলছেন, ইতোমধ্যে সে কাজটা শুরুও হয়েছে হাওয়ায়ের কাহেকিলি মেরিন রিজার্ভে। কিন্তু যেসব জায়গায় প্রবালপ্রাচীর রয়েছে তার মধ্যে অনেকগুলোরই আশপাশে মানুষের বাস। অনেকক্ষেত্রে সহাবস্থানের জন্য এই প্রবালপ্রাচীরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই মোটা দাগে মাছ শিকার নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা করলে হবে না। সারা বিশ্বে বহু মানুষ জীবিকার জন্য মাছের ওপর নির্ভরশীল।

এসবের চেয়েও বড় কথা হলো পানি দূষণ কমানো গেলে তা প্রবাল ও মানবস্বাস্থ্য উভয়ের জন্যই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।

প্রোসেডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রবালের ব্লিচপ্রতিরোধী হয়ে ওঠাও সম্ভব, যদি মানুষ একটু ভূমিকা রাখে।

ক্যারিবিয়ান ও গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে পরিবেশবাদীরা ইতোমধ্যে নার্সারি থেকে নিয়ে হাজারো প্রবাল স্থাপন করা শুরু করেছেন। শুরুতে তারা সেই প্রবালগুলোকেই বাছাই করছেন যেগুলো ইতোমধ্যে তাপপ্রবাহ থেকে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। কিন্তু এ কাজটা করতে গেলে যেটা ঘটছে সেটা হলো- শুধুমাত্র সেই প্রবালই স্থানান্তর করা যাচ্ছে যেটা ব্লিচপ্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এটা সম্ভব যে, এই প্রবালগুলোর তাপের ধকল কাটিয়ে ওঠার মতো শক্তিশালী হওয়ার জন্য তাদের আবাসস্থল ভূমিকা রেখেছে। আবার এমনও হতে পারে যে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়ার জন্য তারা নতুন করে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

এই ব্লিচপ্রতিরোধী ক্ষমতা কিভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় তা বুঝতে বিজ্ঞানীরা হাওয়াইয়ে পাওয়া প্রবাল থেকে কিছু টুকরা সংগ্রহ করেন যেগুলো পরপর দুটি তাপপ্রবাহ সহ্য করেছে। এরপর সেটি পুরো প্রাচীরের বিভিন্ন স্থানে নেওয়া হয়।

নতুন পরিবেশে স্থিতিশীল হতে প্রবালগুলোর কয়েক মাস সময় লেগে যায়। কিন্তু তারপর পরীক্ষাগারে দেখা যায় দুই অংশের পাথরেই তাপপ্রতিরোধী একটা বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে। আর যেহেতু একটি প্রবালে হাজারো জেনেটিক্যালি আইডেনটিক্যাল অর্গানিজম থাকে তাই তাপপ্রতিরোধী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রবাল প্রতিস্থাপনের পর সেটা পুরো প্রবালপ্রাচীরেই তাপসহিষ্ণু বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিতে পারে।

দুটি গবেষণার তথ্য একত্রিত করলে সেখান থেকে প্রবাল বাঁচানোর বহুমুখী পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যায়।

ডোনোভ্যান বলছেন, প্রবাল কমে যাওয়ার জন্য যারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত, তাদের অনেকেরই জলবায়ু সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নে কোনো ভূমিকা রাখার ক্ষমতা নেই। আর ২০১৫ সালে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে বড় আকারে ব্লিচিংয়ের ঘটনাগুলোর মতো খবর ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে অনেকে নিরুৎসাহিত করে। তাই আমাদের কাজ পরিষ্কারভাবে এই বার্তা দিচ্ছে যে প্রবালের সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য সব পর্যায় থেকে ভূমিকা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : নাঈম ফেরদৌস রিতম। 

এনএফ