জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি যেমন বাংলাদেশসহ বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে তেমনি বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো জেলায় বজ্রপাতে মৃত্যু হওয়ার খবর আসছে সংবাদ মাধ্যমে। তথ্য মতে, বিশ্বের বেশি বজ্রপাত সংঘটিত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে ভেনিজুয়েলার মারাকাইবো হ্রদে সবাই ওপরে। রয়েছে আফ্রিকার কঙ্গো ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। এ তালিকায় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বাংলাদেশর নামও রয়েছে।

ডিজাস্টার ফোরামের গবেষণা সহযোগী রাফায়াত ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, ২০২১ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মোট ২৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৫৪ জন, নারী ৩৯ এবং পুরুষ ১৭৯ জন।

বজ্রপাতে এ বছর সবচেয়ে বেশি মারা গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় (৩২ জন)। এছাড়া সিরাজগঞ্জ জেলায় ১৯ জন এবং জামালপুরে ১৬, নেত্রোকোনা ১৫, চট্টগ্রামে ১২ এবং কিশোরগঞ্জ ১০ জন মারা গেছে। সবশেষ আজ (০৪ আগস্ট) চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় বজ্রপাতে ১৭ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন পুরুষ, ৫ জন নারী।

দেশের ২০১১ সালের পর থেকে বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রবণতা ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে। ২০১৫ সালে ৯৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৫১, ২০১৭ সালে ২৬২, ২০১৮ সালে ৩৫৯, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন। এছাড়া ২০২০ সালে বজ্রপাতে মারা গেছে ৩৮০ জন। এর মধ্যে শিশু ৮০, নারী ২৯, এবং পুরুষ ২৭১ জন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরামসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, গত এক দশকে (২০১০ সাল থেকে) দুই হাজারের বেশি মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন কয়েক হাজার নারী-পুরুষ। এর মধ্যে বেশিরভাগই মাঠে কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন।

কেন বজ্রপাত হয়?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বায়ুমণ্ডলে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জের গঠন ও পৃথকীকরণে বজ্রপাত সংঘটিত হয়। যখন আকাশে প্রচুর মেঘ জমে, আর তা ভূপৃষ্ঠের খুব কাছে চলে আসে তখনই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে (এপ্রিলের পর) দেশে বজ্রপাত বেশি হয়।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল এ অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই বেশি বজ্রপাত হয়। কেননা, এই অঞ্চলে বজ্রমেঘের সৃষ্টিই হয় বেশি। বজ্রমেঘ বেশি তৈরি হওয়ার কারণও প্রাকৃতিক। পৃথিবীর আদিকাল থেকেই বজ্রপাত ছিল। তবে মৃত্যুর হার সম্প্রতি বেড়েছে বলেই মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।

ফিনল্যান্ডের বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালার তথ্য মতে, দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭০ শতাংশ ঘটনা ঘটে মাঠে-ঘাটে কৃষিকাজ করার সময়। এ ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে সাড়ে ১৪ শতাংশ এবং গোসল করা ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা মতে, আমাদের প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০টি বজ্রপাত হয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। তাই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।

বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়
বজ্রপাত নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের দেওয়া কিছু দিকনির্দেশনা তুলে ধরা হলো- 

# বজ্রপাত সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময় ঘরে বা বাসাবাড়িতে অবস্থান করুন।

# ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে না যাওয়া ভালো। তবে অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হতে পারবেন।

# বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ অথবা উঁচু স্থানে থাকবেন না।

# এ সময়ে ধান ক্ষেতে বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকুন।

# বজ্রপাতের আশঙ্কা হলে যত দ্রুত গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন।

# কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকুন।

# বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে, গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না, সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন।

# বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দার থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকুন।

# বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন এবং এগুলো বন্ধ রাখুন।

# বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করবেন না। জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করতে পারেন।

# এ সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন।

# বজ্রপাতের সময় ছাউনবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাবেন না, তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করুন।

# বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না।

# প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করুন।

# খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যান।

# কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যান।

# বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

এসএম