কিছুদিন ধরে প্রায় শুনে থাকছি এয়ারলাইন্সগুলোর ভাড়া অনেক বেশি। আগে তো এই ভাড়া ছিল, এখন কেন এতো বেশি? প্রি-কোভিডে অর্ধেক ভাড়ায় বিদেশ যাওয়া যেতো, এখন অনেক বেশি টাকা প্রয়োজন হয়। ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্ন শুনতে হয় এয়ারলাইন্স ও ট্রাভেল এজেন্সির কর্মীদের। 

কোভিডের মাঝপথে বিশেষ করে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জেট ফুয়েলের প্রাইস ছিল ৪৬ টাকা প্রতি লিটার। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১১৮ টাকা প্রতি লিটার। মাস চারেক আগেও ছিল ১৩০ টাকা লিটার। শতকরা হিসেবে দাম বেড়েছে ১৬০ শতাংশের বেশি। পূর্বে এয়ারলাইন্সগুলোর পরিচালন ব্যয়ের ৪০-৪২ শতাংশ ব্যয় হতো জেট ফুয়েল ক্রয়ে। আর বর্তমানে পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৫০ শতাংশের অধিক ব্যয় হয় জেট ফুয়েল বাবদ।

এয়ারক্রাফট কিংবা এয়ারক্রাফট যন্ত্রাংশ আমদানি বাবদ কাস্টমস ডিউটি বেড়েছে প্রি-কোভিড থেকে প্রায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ। যা সরাসরি ভাড়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

বাংলাদেশে কোভিডকালীন বিমানবন্দর উন্নয়ন চার্জ ও সিকিউরিটি বাবদ দু’টি চার্জ নতুন করে সংযোজিত হয়েছে, যা প্রি-কোভিডে ছিল না। এই চার্জগুলোও ভাড়ার ওপর প্রভাব ফেলেছে।

এমআরও সেন্টারগুলোতে এয়ারক্রাফট মেইনট্যানেন্স এর জন্য খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। সঙ্গে কোভিড পরবর্তী সময়ে মেইনট্যানেন্স সিডিউল না পাওয়ার কারণেও বিশ্বের অধিকাংশ এয়ারলাইন্স তাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট সিডিউল মেইনটেইন করতে পারছে না। ফলে সিট ক্যাপাসিটির চেয়ে যাত্রী চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ভাড়া বৃদ্ধিতে প্রভাব বিস্তার করেছে।

বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ডলারের দামের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ার কারণে কোভিড-১৯ কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মারাত্মকভাবে এয়ারলাইন্সগুলোর ভাড়া বৃদ্ধিতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বছরখানেক আগেও ১ ডলারের বিনিময়ে ৮৩/৮৪ টাকা পাওয়া যেত, এখন সেখানে ১ ডলারের বিনিময়ে ব্যয় করতে হয় ১১৫-১২০ টাকা। ফলে ভাড়ায় সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। 

বাংলাদেশে এয়ারলাইন্সগুলো টিকিট বিক্রয় করছে টাকায়, কিন্তু সব ধরনের খরচগুলো বহন করছে ডলারে। বিশেষ করে ইন্স্যুরেন্স, লিজিংমানি, ব্যাংক ইন্টারেস্ট, ফুয়েল প্রাইস, বিভিন্ন দেশের অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ, আইএটিএ পেমেন্টসহ নানাবিধ খরচ সবই ব্যয় করতে হয় ডলারে। ফলে এয়ারলাইন্সগুলো খরচের সঙ্গে আয়ের সমন্বয় করতে ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি পেলে, ডলারের বিনিময়ে টাকার মান বৃদ্ধি পেলে, জেট ফুয়েলের মূল্য হ্রাস পেলে আনুপাতিক হারে যাত্রী ভাড়া কমার সম্ভাবনাও রয়েছে।

অপরদিকে অর্থনীতির সাধারণ সংজ্ঞা যোগানের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে থাকে। কোভিড পরবর্তী সব দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর কিংবা ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা কেটে যাওয়ার পর বিমান যাত্রী বেড়েছে কয়েকগুন। সেই তুলনায় আসন সংখ্যা বাড়ানোর কোনও সুযোগ ছিল না। ফলে বিভিন্ন রুটে যাত্রী চাহিদার কারণেও কিছুটা ভাড়া বেড়েছে।

প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে নিজেদের আয়ের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেই ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। বিশ্ব এভিয়েশনে কিংবা বাংলাদেশে ব্যয়ের সূচক যদি উর্ধ্বগামী থাকে তাহলে এয়ারলাইন্সগুলো নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য এবং পূর্ণাঙ্গ যাত্রী সেবাকে নিশ্চিত রাখার জন্য খরচগুলোকে ভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করে থাকে। 

এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে পারবে যদি নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন না হয়। বাংলাদেশ এভিয়েশন ব্যবসাটা পরিচালিত হচ্ছে ভর্তুকি বিহীন। বিগত দিনে নানাবিধ কারণে বাংলাদেশ এভিয়েশন থেকে হারিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া বিশ্বের আকাশ দাপিয়ে বেড়ানো জিএমজি, ইউনাইটেড কিংবা রিজেন্ট এয়ারওয়েজসহ সাত আটটি এয়ারলাইন্স। 

বর্তমানে পরিচালিত জাতীয় বিমান সংস্থাসহ চারটি এয়ারলাইন্স খরচের সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ করে বাংলাদেশ এভিয়েশনে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, সঙ্গে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে মার্কেট শেয়ার ধরে রেখে দেশের জিডিপিতে অবদান রাখার চেষ্টা করছে।     

লেখক : মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স